একের পর এক বাঁধ দিয়ে হালদার উৎসে চলছে মৎস্য চাষ। তাতে বন্ধ হয়ে গেছে পানির স্রোত। এমনকি যেখানে এ নদীর উৎপত্তিস্থল, সেখানকার অধিবাসীরা জানেই না স্থানটি হালদার উৎসস্থল। সেখানে এতদিন ধরে ছিল না সরকারি স্থাপনা কিংবা সাইনবোর্ড। ফলে এটি সম্পর্কে মানুষের কাছে অজানাই রয়ে গেছে। আলোচিত জায়গাটির নাম খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলার ২নং পাতাছড়া ইউনিয়নের হাসুকপাড়া এলাকা।খাগড়াছড়ি-রামগড় সড়কের নাকাপা বাজার থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে এটির ভৌগোলিক অবস্থান। দুর্গম জনপদের কারণে সেখানে সাধারণ মানুষের খুব একটা যাওয়া হয় না। এ কারণে এলাকাটি নিয়ে সরকারের আপাতত সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনাও নেই। তাই অনেকটা অরক্ষিত হালদার উৎসস্থল। এ সুযোগে নদীর উৎসস্থলের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে বাঁধ দিয়ে চলছে মৎস্য চাষ।তাতে নদীতে বাঁধা পাচ্ছে পাহাড়ি স্বচ্ছ পানির স্রোত। ঠিক এমনি এক পরিস্থিতিতে অরক্ষিত হালদার উৎসস্থলে প্রথম সাইনবোর্ড গেঁড়েছে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)। সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে এটি স্থাপন করা হয়। তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে হালদা সংশ্লিষ্টরা।বিশেষজ্ঞদের মতে, রামগড় উপজেলার ২নং পাতাছড়া ইউনিয়নের পাহাড়ি ক্রিক থেকে সৃষ্ট হালদাছড়া থেকে দেশের রুই জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর উৎপত্তি। হালদা ছড়া মানিকছড়ি উপজেলার বেলছড়া ও সালদা ছড়া খালের সাথে মিলিত হয়ে হালদা খাল এবং ফটিকছড়ির ধুরং খালের সাথে মিলিত হয়ে হালদা নদীতে পরিণত হয়েছে।পরবর্তীতে এই নদী চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার মধ্যদিয়ে প্রায় ৯৮ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। রামগড়ে উৎসস্থল থেকে মানিকছড়ি উপজেলা সীমান্ত পর্যন্ত হালদা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮ কিলোমিটার। দুর্গম পাহাড়ি জনপদের কারণে বিশাল এ এলাকা অনেকটা অরক্ষিত। তামাক চাষ, বালি উত্তোলনের জন্য নদীর তীর কেটে ফেলা এবং বৃক্ষ নিধনের মতো সব ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চলছে অবলীলায়।এদিকে, উৎসস্থলে সাইনবোট স্থাপন প্রসঙ্গে ‘আইডিএফ’র নির্বাহী পরিচালক জহিরুল আলম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘সুপেয় পানি ও রুই জাতীয় মাছের প্রজননের জন্য খ্যাত হালদা বাংলাদেশের সম্পূর্ণ একক নদী। সুতরাং এ নদী রক্ষায় সমন্বিত পরিকল্পনা থাকা দরকার। তারই আলোকে হালদাকে নিয়ে কাজ করছে আইডিএফ। আমরা জানতে পেরেছি, এ নদীর উৎসস্থল অরক্ষিত। সেখানে কোন চিহ্ন নেই। তাই রামগড়ে উৎসস্থলে আইডিএফ’র পক্ষ থেকে সাইনবোর্ড স্থাপন করেছি। আশা করি, সরকার এই উৎসস্থল নিয়ে সমন্বিত একটি উদ্যোগ গ্রহণ করবে।’উৎসস্থল প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির কো-অর্ডিনেটর প্রফেসর ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘হালদা নদী সংরক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে উৎসস্থল সংরক্ষণ। বাংলাদেশের অন্যান্য নদীগুলোর উৎস বাংলাদেশ না হওয়ায় এই নদীগুলো সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জটিল। এক্ষেত্রে হালদা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা অনেকটা সক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু হালদা নদীর উৎসস্থলকে এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে, সম্প্রতি উৎসস্থলে সাইনবোর্ড দিয়েছে আইডিএফ।তাই শুধু ভাটি এলাকা নয়, সম্পূর্ণ হালদা নদীকে ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। ১০ বছর আগে প্রথম যখন হালদা নদীর উৎসস্থলে যাই, ঠিক তখনকার পরিবেশ এবং বর্তমান পরিবেশের মধ্যে তুলনামূলক অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে উৎসস্থলে অনেক বাড়িঘর তৈরি হয়েছে, পানির উৎস পাহাড়ি ক্রিকগুলো বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখা হয়েছে। বৃক্ষ শূন্য করা হয়েছে পাহাড়গুলো।’প্রফেসর মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে হালদা নদীকে সংরক্ষণ করতে হলে, এর উৎসস্থল সংরক্ষণের কোন বিকল্প নেই। পানির উৎস পাহাড়ি ক্রিকগুলোকে উন্মুক্ত রাখতে হবে। হালদা বেসিনের পাহাড়গুলোতে বৃক্ষায়ন করতে হবে। সর্বোপরি উৎসস্থলকে ঘিরে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।রামগড়ের পাতাছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী নুরুল আলম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘হালদা নদীকে মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হলেও নদীর উৎপত্তিস্থলের বাসিন্দারা এর কিছুই জানে না। এছাড়া এ নদী যে একটি বিখ্যাত নদী এ কথাও এখানকার মানুষের অজানা। সরকারিভাবেও নদীটির গুরুত্ব ও ঐতিহ্য সম্পর্কে এখানকার বাসিন্দাদের জানানোর কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এমন কি মৎস্য হেরিটেজ ঘোষিত হওয়ার দুই বছরেও উৎপত্তিস্থলে ন্যুনতম একটি সাইনর্বোড বা বিলর্বোডও স্থাপন করা হয়নি।’ঐতিহ্যবাহী নদীটির উৎপত্তিস্থল দেখার জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এখানে আসেন। কিন্তু যাতায়াতের পাকা রাস্তা না থাকায় সবাইকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জরুরিভাবে রাস্তাটি ইটের সলিন করা দরকার।’ কাজী নুরুল আলম বলেন, ‘নদীটির বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া হলে মানুষ এ নদীর ব্যাপারে যত্নবান হতো।’রামগড় উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দোকার মো. ইখতিয়ার উদ্দীন আরাফাত দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘রামগড়ের উৎপত্তিস্থল হতে হালদা নদীর নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে গ্রামবাসীরা মাটির বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো এবং কোথাও কোথাও জমি বানিয়ে ধান চাষাবাদের কথা শুনেছি। এ ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি সদস্য, হেডম্যান, কার্বারির মাধ্যমে গ্রামবাসীদের ঐতিহ্যবাহী এ নদী রক্ষায় সচেতন করা এবং নদীর জলধারা স্বাভাবিক রাখতে মাটির বাঁধ সরাতে বলা হয়েছে। এছাড়া হালদার উৎসস্থলে যাওয়ার রাস্তার উন্নয়নেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে।’রামগড় উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কিমার কারবারি দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদী আমাদের দেশের গর্ব, অমূল্য সম্পদ। ঐতিহ্যবাহী এ নদীর রামগড়ের উৎপত্তিস্থল রক্ষা এবং উন্নয়নে উপজেলা পরিষদ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকেও এগিয়ে আসতে হবে।