ইবরাহিম আদহাম ছিলেন বলখের বাদশাহ। বলখের ভৌগলিক অবস্থান ছিল বৃহত্তর ইরানে। বর্তমান আফগানিস্তানের একটি প্রদেশের নাম বলখ। মওলানা রুমি (রহ.) এর জন্মস্থানও ছিল এই বলখ। সেখান থেকে খোরাসানের নিশাপুর ও তেহরান উপকণ্ঠের রেই শহর হয়ে প্রথমে মক্কায়, পরে সিরিয়া ও তারপর তুরস্কের কুনিয়ায় চলে যান। সেখানেই তার অন্তিম শয়ান মাজার। বাদশাহ ইবরাহিম আদহামের আধ্যাত্মিক ভাবান্তরের একটি কাহিনিকে মওলানা রুমি (রহ.) উপজীব্য করেছেন মসনবিতে। গবেষকদের মতে, এই কাহিনির উৎস ফরিদ উদ্দীন আত্তার প্রণীত ‘তাযকিরাতুল আউলিয়া’। তাতে বলা হয়েছে, প্রথম অবস্থায় ইবরাহিম আদহাম বলখের বাদশাহ ছিলেন। তার প্রতিপত্তি ছিল বিশাল একটি রাজ্যের ওপর। তার রাজকীয় শানশওকতের একটি নমুনা ছিল তিনি যখন পথ চলতেন সম্মুখে চল্লিশটি সোনায় মোড়ানো তরবারি আর পেছনে সোনায় মোড়ানো চল্লিশটি গোর্জ (শাবল) সমান তালে চলত। তিনি এক রাতে ঘুমিয়েছিলেন সোনার পালঙ্কে। নিশিরাতে তার কক্ষের ছাদ মড়মড় করে উঠল। টের পেলেন যে, কে একজন ছাদের ওপর হাঁটছে। ইবরাহিম আদহাম ডাক দিলেন কে এত রাতে ঘরের ছাদে? বলল, অপরিচিত কেউ নয়; আমার উটটা হারানো গেছে তো খোঁজ করছি। ইবরাহিম আদহাম বললেন, কী ধরনের আহম্মক! ঘরের ছাদে কি উট খুঁজে পাবে? ছাদ থেকে জবাব দিল, ওহে গাফিল! তুমি কীভাবে জমকালো লেবাসে সোনার পালঙ্কে শুয়ে আল্লাহকে পাবে? (তাযকিরাতুল আউলিয়া, ফরিদ উদ্দীন আত্তার, ১খ. পৃ. ৮৬)।মওলানা রুমি (রহ.) সাবার রানি বিলকিসের কাছে হজরত সুলায়মান (আ.) এর পত্র নিয়ে আলোচনা করছিলেন। রানি বিলকিস দুনিয়াবি রাজত্ব ছেড়ে কীভাবে হেদায়তের রাজত্ব বরণ করেছিলেন তা বিশ্লেষণ করছিলেন। মওলানা বিষয়টিকে আমাদের বোধ ও চেতনার কাছে আনার জন্য ইবরাহিম আদহামের কাহিনির অবতারণা করেছেন। তাযকিরাতুল আউলিয়ার ঘটনাকে তিনি নিজের চিন্তাদর্শনের আলোকে সাজিয়ে বলেছেন, তুমি ইবরাহিম আদহামের মতো দুনিয়ার রাজত্বকে তুচ্ছজ্ঞান করো, তাহলে দেখবে, চিরন্তন রুহানি রাজত্ব তোমার হাতের নাগালে এসেছে। মওলানা রুমির ভাষায়, খোফতে বূদ আ’ন শাহ শবা’নে বর সরীর হারেসা’ন বর বা’ম আন্দর দা’র ও গীর ঘুমিয়েছিলেন সেই বাদশাহ পালঙ্কে নিশিরাতে প্রহরীরা সজাগ পাহারায় বাড়ির ছাদে আশেপাশে। ৭২৭
রাজপ্রাসাদে প্রহরী নিয়োগের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে বলেন, বাদশাহ যে প্রহরী নিয়োগ করেছিলেন তা চোর-ডাকাত বা আততায়ী পাহারা দেওয়ার জন্য নয়। কারণ, বাদশাহ জানতেন যে, যে শাসক ন্যায়বিচারক তার প্রহরী দেহরক্ষীর প্রয়োজন হয় না। কোনো দুর্ঘটনা-দুর্বিপাকের ভয়ে তার মন বিচলিত নয়। কারণ, মানুষের জীবন ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রহরী তো তার ন্যায়বিচার। কাজেই প্রহরীদের ঢোলের বাড়ি, সানাইর সুরে সময়ের সদ্ব্যবহারের তাগাদা পাবেন, পরকালীন দায়িত্বের কথা স্মরণ হবে, বিশেষত সৃষ্টিজগতে বিরাজিত চিরন্তন সুরলহরির সঙ্গে সংযোগের প্রেরণা পাবেন, সে উদ্দেশ্যেই প্রহরা ও প্রহরীর এত আয়োজন। যাহোক নিশিরাতে এক অস্বাভাবিক আওয়াজ ছাদের ওপর মড়মড় করে উঠল। ঘুম ভেঙে বিচলিত বাদশাহ। বুঝতে পারেন না, হঠাৎ এমন আওয়াজের হাকিকত কী। দ্রুত জানালার দিকে গেলেন। মাথাটা বের করে আওয়াজ দিলেন, কি হে ছাদের উপর কী হচ্ছে? এমন ভয়ানক হুড়মুড় আওয়াজ কিসের? ছাদের উপর থেকে কতক লোক মাথা ঝুলিয়ে জবাব দিল, রাতের বেলা আমাদের বাহন উটগুলো হারিয়েছি তো। তাই এখানে উটের সন্ধান করছি। হীন চে মী জুয়ীদ গোফতন্দ উশতোরা’ন গোফত উশতোর বা’ম বর কী জুস্ত হা’ন
ওহে কী খোঁজো? বলল আমাদের হারানো উটগুলো বললেন, উট! বাড়ির ছাদে কেউ উট খোঁজে, বলো। ৮৩৩ পস বেগোফতন্দাশ কে তো বর তখতে জা’হ
চোন হামী জুয়ী মোলা’কা’তে ইলা’হ তারা বলল, তাহলে তুমি সিংহাসনে বসে
কীভাবে আশা কর, আল্লাহর সাক্ষাৎ পাবে? ৮৩৪
খোদ হামুন বুদ দীগর উ রা’ কাস নদীদ চোন পরি আয আদমী শুদ না’পদীদ
একথার পর তাকে আর কেউ দেখেনি সিংহাসনে
জিনপরীর মতো চলে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তর্ধানে। ৮৩৫ রাতে রাজপ্রাসদের ছাদে রহস্যজনক বিচরণকারীদের মুখে যেই না মন্তব্যটি শুনলেন, ইবরাহিম আদহামের জীবনে ঘটে গেল আমূল পরিবর্তন। তার সামনে উদ্ভাসিত হলো জীবনের রহস্য, আসল হাকিকত। বুঝতে পারলেন, জীবনের প্রকৃত সুখ ও সাফল্য অর্থবিত্ত দুনিয়াবি রাজত্বের মধ্যে নয়। তাই তিনি যাহেরি রাজত্ব, রাজকীয় প্রতাপ-প্রতিপত্তি ত্যাগ করলেন। একই সঙ্গে তার রুহানি মর্যাদা মানুষের দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। কেননা,
মা‘নিয়শ পিনহা’ন ও উ দর পীশে খলক
খলক কেই বীনদ গাইরে রীশ ও দলক তার আধ্যাত্মিকতা গোপন আর তিনি মানুষের কাছে
মানুষ কী বুঝতে পারে দাড়ি আলখেল্লা ব্যতিরেকে।
ইবরাহিম আদহাম মানুষের মাঝে বিচরণ করেন। তবে রাজকীয় প্রতাপ-প্রতিপত্তির দাপট তার নেই। তিনি এখন আধ্যাত্মিক ঐশ^র্যে বলীয়ান। কিন্তু তার এই আধ্যাত্মিকতা মানুষের কাছ থেকে গোপন। কারণ, মানুষ আধ্যাত্মিকতা পরিমাপ করে দাড়ি আর আলখেল্লা দেখে। রাজত্বের সিংহাসনে ইবরাহিম আদহামের এই উত্তরণ তাকে নিয়ে গেছে আধ্যাত্মিকতার অনন্ত নীলিমায়।
চোন যে চশমে খোদ ও খলকান দূর শুদ হামচো আনকা দর জাহা’ন মশহুর শুদ
যখন তিনি আড়াল হলেন নিজের ও অন্যের দৃষ্টি থেকে
বিহঙ্গের মতো অদৃশ্য অথচ খ্যাতিমান হলেন জগতে। অন্যের দৃষ্টির আড়ালে যাওয়া মানে নিজের আধ্যাত্মিক যোগ্যতা ও প্রাপ্তি লোকসমাজে জানতে না দেওয়া। আর নিজের দৃষ্টি থেকে আড়াল হওয়া মানে আমিত্ব আত্মগরিমা, সুনাম সুখ্যাতির লোভ ও ক্ষমতার অহঙ্কার থেকে মনপ্রাণ মুক্ত করা। মওলানা মানব মনের এই অবস্থার আরও হকিকত বর্ণনা করে বলেন, কুহকাহফ পর্বতে একটি পাখির বসবাস বলে পৌরাণিক রূপকথায় প্রচলিত। সেই পাখির সাক্ষাৎ পেলে দুনিয়ার পাখিদের জীবন ধন্য হবে। তার নাম বিহঙ্গ, সিমোরগ, আনকা নামেও খ্যাত। আনকা কেউ চোখে দেখেনি; অথচ তার খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। দুনিয়ার লোভ মোহের বন্ধনমুক্ত ইবরাহিম আদহামদের জীবনেও বিহঙ্গ পাখি ছায়াপাত করে। মওলানা আরও বলেন, যে পাখি বিহঙ্গের সাক্ষাৎ লাভের আশায় কুহকাফ পর্বতের পানে ধাবিত হয়, জগতবাসী তাকে নিয়ে আলোচনায় মুখরিত হয়। হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত, ‘আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন জিবরাইলকে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন। কাজেই তুমি তাকে ভালোবাস। তখন জিবরাইল তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। অতঃপর জিবরাইল আসমানের বাসিন্দাদের মাঝে খবরটি প্রচার করে বলেন, আল্লাহ অমুককে ভালোবাসেন কাজেই তোমরাও তাকে ভালোবাস। তখন আসমানবাসী তাকে ভালোবাসতে থাকে। এরপর দুনিয়াতে তার গ্রহণযোগ্যতা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বোখারি শরিফে হাদিসটি বর্ণিত।
মওলানা বুঝিয়ে বলেন, ইবরাহিম আদহাম নিশিরাতে বাড়ির ছাদে অশরীরী প্রাণীদের বাণী শুনে হেদায়তের সিংহাসনের সঙ্গে বলখের সিংহাসন বিনিময় করেছিলেন। রানি বিলকিসের অবস্থাও ছিল তাই। ঈমানের দাওয়াত সংবলিত হজরত সুলায়ামানের (আ.) চিঠি সাবায় পৌঁছলে বিলকিস ও জনগণের মাঝে আনন্দের ধুম পড়ে যায়। দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন শহরে পুনঃসংযোগ স্থাপনের মতো এতদিনের মৃত জনপদে জীবন প্রবাহ সঞ্চারিত হয়। দেহের কবরে মৃত প্রাণেরা ডানা ঝাপটাতে থাকে। একে অপরে শুভেচ্ছা বিনিময় করে, আজ এসেছে আমাদের কাছে আসমানি আহ্বান, ঈমানের পয়গাম। এসো হৃদয়ের বাতায়ন খুলে দাও। ইসলামের বসন্তের মলয় সুবাসে আমরা বিমুগ্ধ, প্রাণিত হব সুলায়মানের সাক্ষাতে। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৪খ. বয়েত, ৭২৬-৮৪৪)