১৫ আগস্ট আজ জাতীয় শোক দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৭তম শাহাদতবার্ষিকী। যিনি না থেকেও বাংলার মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু হয়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায়নি। বাংলার জনসাধারণ তাঁকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে।তবে আমাদের এটাও মানতে হবে, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসাই শেষ কথা নয়। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে অনুষ্ঠানসর্বস্ব শোক পালন নয়, তার স্বপ্নের দেশ গড়ে তোলাই হবে তাকে সত্যিকারের সম্মান জানানো। তারচেয়ে বড় কথা, আমাদের সেই আত্মোপলব্ধি কী হয়েছে? সরকার, রাজনৈতিক দল কী তার আত্মদানকে হৃদয়ে, চেতনায় ধারণ করে!অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ আমরা তাঁর মৃত্যুর ৪৭ বছরেও গড়ে তুলতে পারিনি। দেশের নানামুখী উন্নয়নের পরেও আমরা দেখি, পাকিস্তানে দেশের সাধারণ মানুষ যে শোষণ বঞ্চনার শিকার হয়েছে আজও তা থেকে মানুষের মুক্তি মেলেনি। এখনও সম্পদের মালিকানা গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে। সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আজও অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু কী এই বৈষম্যের বাংলাদেশ চেয়েছিলেন!বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের সংগ্রাম ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। তিনি নিজে খুব সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, যা আজকের বাংলাদেশে এক বিস্ময়। দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ও সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবিই ছিল তার বসন এবং ভূষণ। তার সংগ্রাম ছিল মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, মানুষে সমতা সৃষ্টি ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠনের লক্ষ্যে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে দেখা যায়, বাংলাদেশে ধনী-গরীবের যে বৈষম্য তা পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। এখন বাংলাদেশের ধনীদের কানাডার ‘বেগমপাড়ায়’ বাড়ির খোঁজ পাওয়া যায়, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানানোর হিড়িক। যে দেশকে অবলম্বন করে এত টাকার মালিক তারাই এখন ভবিষ্যৎ গড়তে বিদেশে পাড়ি জমাতে ব্যস্ত। এর বিপরীতে. বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই বঞ্চনার শিকার হওয়া মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি।আজ যখন আমরা ১৫ আগস্টকে ফিরে দেখি, তখন মনে হয়, মানুষকে ভালোবাসা ও বিশ্বাস করাই বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হওয়ার বড় কারণ। যিনি এই বাংলাদেশ রাষ্টেÌর স্বপ্নদ্রষ্টা এবং প্রতিষ্ঠাতা, যার কারণে বাঙালি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছে, পেয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পাসপোর্ট— তাকে এরকম নির্মমভাবে ঘাতকের বুলেটে নিহত হতে হবে, তা কল্পনার অতীত! বাংলার মানুষকে তিনি এতটাই বেশি ভালোবেসেছিলেন যে, এদেশের কোনো মানুষ তার সঙ্গে বিশ্বাঘাতকতা করতে পারে, এটা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার অনেক জাতীয়তাবাদী নেতাকে এভাবে হত্যা করা হয়েছে। অনেক নেতার বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। মার্টিন লুথার কিং, চে গুয়েভারা, মহাত্মা গান্ধীসহ অনেকেই মানুষের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। যারা মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। এতকিছুর পরেও মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে তাদের যে আন্দোলন ও লড়াই এ কী বৃথাই রয়ে যাবে? তাদের জীবনদান কী ব্যর্থ হয়ে যাবে?বঙ্গবন্ধুর জীবন প্রবাহ লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই যে আপোসহীনতা, লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকা আর মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসাই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। তার রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ, আন্দোলন পরিচালনার অদম্য সাহস এবং ক্ষমতার প্রতি নির্লোভ হওয়া তাঁকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে যা আমাদের বিস্মিত করে। আর এখানেই বঙ্গবন্ধু অনন্য। তার ত্যাগ, সংগ্রামমুখর জীবন প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে পথ দেখাবে।মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে তারা একের পর এক চক্রান্তের ফাঁদ পেতেছে। সেই চক্রান্তের অংশ হিসেবেই ১৯৭৫ সালের এই দিনে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী উচ্চাভিলাষী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। কী সেই আক্রোশ, যার জন্য একটা পরিবার শুধু নয়, সমগ্র জাতিকেই ধ্বংস করে দেওয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো? বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করাই শুধু উদ্দেশ্য ছিল ঘাতকদের, নাকি রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও দেশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য কাজ করেছে? তাহলে তো এটাকে নিছক বিপথগামী সেনা সদস্যদের আক্রমণ বলা যাবে না। বলতে হবে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশিয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। যে চক্রান্ত নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছিল, হত্যা করতে চেয়েছিল বাংলাদেশকে। তা সফল হয়নি। নশ্বর পৃথিবীতে বঙ্গবন্ধু বিলীন হয়ে গেলেও তার প্রেরণা অবিনশ্বর হয়ে বিরাজ করছে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে।জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দিবসটি পালন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে ঘাতকের হাতে নিহত হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্ণেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক। প্রায় একই সময়ে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে হত্যা করে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা চালিয়ে হত্যা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খানকে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। জাতি আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে সকল শহীদকে।এদিকে, গবেষক খালেক বিন জয়েনউদদীনের গবেষণায় উঠে এসেছে, সেদিন কামানের গোলায় বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িতে খুনি মহিউদ্দিন আহমেদের ছোড়া কামানের গোলায় মোহাম্মদপুর, শেরশাহ সুরী রোডের ৮, ৯, ১৯৬, ১৯৭ নম্বর বস্তিঘরে নিহত হন রিজিয়া বেগম, শিশু নাসিমা, রাশেদা বেগম, সাবেরা বেগম, আনোয়ারা বেগম-১, আনোয়ারা বেগম-২, সুফিয়া খাতুন, সয়ফুল বিবি, হাবীবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, শাহাবুদ্দীন আহমদ, আমিন উদ্দীন আহম্মদ প্রমুখ।জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর বাণীতে জাতির পিতাকে হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে সকলকে আত্মনিয়োগ করার আহবান জানিয়েছেন। রাষ্টÌপতি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হবে জ্ঞান-গরিমায় সমৃদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করে বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। তাহলেই চিরঞ্জীব এই মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোক দিবসের বাণীতে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করলেও তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং গণতন্ত্র বিরোধী চক্র এখনও নানাভাবে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। এই অপশক্তির যে কোন অপতত্পরতা-ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করে দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। বাণীতে তিনি সশ্রদ্ধচিত্তে ১৫ আগস্টের সকল শহীদকে স্মরণ এবং তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।এছাড়াও শোক জানিয়ে বাণী দিয়েছেন জাতীয় পার্টি জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের এমপি, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি প্রমুখ।