বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ফের মর্টারশেল নিক্ষেপ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মুহুর্মুহু গোলা নিক্ষেপের শব্দ শোনা গেছে। এতে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু এবং উখিয়া উপজেলার পালংখালীর আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত প্রকম্পিত হয়েছে সারাদিন।এসব কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলসীমান্ত ঘেঁষে এপারে বসবাস করা কয়েক হাজার বাসিন্দা ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বিশেষ করে গত মঙ্গলবার থেকে সীমান্তের অদূরেই সংঘটিত ভয়ানক গোলাগুলির ঘটনায় আতঙ্কের মুখে পড়েছেন তারা। নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিজিবি সদস্যরা স্থানীয় লোকজন ছাড়া বাইরের কাউকে অহেতুক এলাকায় ঢুকতে কড়াকড়ি নিশ্চিত করেছেন। আজ সরেজমিন ঘুমধুমের তুমব্রু ও পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়া গেলে এমন ভয়ের কথা জানান সীমান্তে বসবাসকারী পরিবারের লোকজন তারা জানায়, প্রায় দেড় মাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ও তুমব্রুসহ আশেপাশের সীমান্তে গোলাগুলি ঘটলেও গত সপ্তাহ থেকে আঞ্জুমান পাড়া সীমান্তেও গোলাগুলি শুরু করে। এরমধ্যে মঙ্গলবার বিমান থেকে গোলাবর্ষণ এবং বৃহস্পতিবারের গোলাগুলির ঘটনা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। যার ভীতি কাটছে না।পালংখালী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাফরুল ইসলাম জানান, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত বৃহত্তর আঞ্জুমান পাড়ার দক্ষিণ ও পূর্ব ফাঁড়িরবিল সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া, চাম্বাকাটা, বলিপাড়া, কোয়াইংচিপং ও মেধিপাড়া বরাবর পাহাড়ি এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। শুরু থেকে এদিকে গোলাগুলি হয়নি। সপ্তাহ ধরে একদিন পর পর গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। মঙ্গলবারের পর বুধবার বন্ধ থাকলেও বৃহস্পতিবার আবারও গোলাগুলির ঘটনা স্থানীয়দের মনে চরমভাবে ভয় সৃষ্টি করেছে। এতে আঞ্জুমান পাড়ার প্রায় ১০ হাজার এবং তুমব্রু এলাকার বেশ কয়েক হাজার মানুষ নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পূর্ব আঞ্জুমান পাড়ার বাসিন্দা আকবর হোসেন বলেন, ‘গোলাগুলির ব্যাপকতা বাড়ায় আমরা আতঙ্কে রয়েছি। মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার গোলাগুলির পর ভীতি বেড়েছে। বাংলাদেশি নাগরিক হলেও বাড়িতে থাকতে ভয় হচ্ছে। পরিস্থিতির ওপর ভর করে সরে যেতে অনেকে প্রয়োজনীয় পণ্য গুছিয়ে রেখেছেন।’নাইক্ষংছড়ি-ঘুমধুম সড়কের ইজিবাইক চালক ফারুক আহমদ (৫০) বলেন, ‘ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তে সকাল থেকে প্রচণ্ড মর্টার সেল ও গুলির বিকট শব্দে রাস্তা দিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবারের গোলায় প্রচণ্ড শব্দ কলিজা কাঁপাচ্ছে। সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শব্দ প্রচণ্ড শব্দে এপারে অপ্রয়োজনে কেউ ঘর থেকে বের হয়নি।তুমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসান (৬৫) বলেন, ‘বিগত দেড় মাস যাবত মিয়ানমারে সংঘাতের বাহানায় সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ও হতাশা বেড়েই চলছে। গোলাগুলির আওয়াজে কাঁপছে সীমান্ত ঘেঁষা হেডম্যান পাড়া। প্রায় ঘরের দরজা বন্ধ।ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘সীমান্তের ১ থেকে ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকাগুলোতে বৃহস্পতিবারের মতো এমন বিকট শব্দ আগে শোনা যায়নি। সকালে থেকে বিকেল পর্যন্ত অনবরত মর্টার সেল ও ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দ শোনা গেলেও ৩টা পর্যন্ত থেকে থেমে মর্টারশেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে।ঘুমধুম ৩ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘মর্টারশেল ও গুলির আওয়াজের শব্দে এলাকায় নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। রাস্তা-ঘাট ফাঁকা, বাজারে প্রায় ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধে করে নিরাপদ স্থানে রয়েছে। ওয়ার্ডের উত্তরপাড়া, বাজুবনিয়া, উলুবনিয়া, হেডম্যানপাড়া, বাসবাগান পাড়া, বাইশ ফাঁড়ি, দক্ষিণ পাড়া, বাইশফাড়িঁ মধ্যম পাড়া সীমান্তের কাছাকাছি হওয়া ভয়ে ও আতঙ্কে অনেকেই দুরের আত্মীয় স্বজনের কাছে চলে গেছে। যারা এখানে রয়েছে তারা বাড়ি থেকে তেমন বের হয়না।২ নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রু বাজারের দোকানি মির আহমদ (৫৩) বলেন, ‘তুমব্রু বাজারে লোকসমাগম নেই বললে চলে। পেটের দায়ে দোকানটি খুলে রেখেছি। মর্টারশেলের শব্দে দোকানে বসে থাকা যায় না, ব্যবসা নিয়ে চিন্তায় আছি।’তুমব্রু নোম্যান্সল্যান্ডের বাসিন্দা রোহিঙ্গা মোহাম্মদ সাদেক (৩৫) বলেন, ‘মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের গত দুদিনের ঘটনা আমাদেরকে নতুন করে আতঙ্কিত করে তুলেছে। ২০১৭ সালে অত্যাচার নির্যাতনে আরকান রাজ্য থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর শূন্যরেখায় এখন চরম আতঙ্কিত আমরা।উখিয়ার পালংখালি অঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা সাবেকু নাহার (৩৭) বলেন, ‘গত তিন ও চারদিন যাবত মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় ভারী অস্ত্রের শব্দে নিত্য কাজ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে বেশি গুলির বিকট শব্দ শোনা গেছে।’পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আঞ্জুমান পাড়ার সীমান্তের বাসিন্দাদের ঝুঁকির বিষয়টি আমরা সব সময় পর্যবেক্ষণে রাখছি। ইতোমধ্যে প্রশাসনের উচ্চ মহল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনের তালিকা তৈরির কথাও বলেছে। সে মোতাবেক বিজিবির সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় ইউপি সদস্য তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।’উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজীব বলেন, ‘উখিয়া সীমান্তে ঝুঁকির মুখে থাকা বাসিন্দাদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছি। পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’এদিকে, এর আগে মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষা বান্দরবানের তুমব্রু সীমান্ত থেকে আরও তিন শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন। সীমান্ত ঘেঁষে অব্যাহত সংঘর্ষ এবং শুক্রবার (১৬ সেপ্টেম্বর) মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেল বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন হতাহতের প্রেক্ষিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির পরামর্শে এ সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় প্রশাসন।