বিয়ের দিনের কথা মনে পড়লে এখনো শিহরিত হই। ঐ দিনটি ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর দিন। সেই কষ্টের কথা কখনো মুখে বলতে পারিনি। আমি চাই—এমন বিয়ে যেন কোন কিশোরীর জীবনে না ঘটে। বাল্যবিবাহ একটা মেয়ের জীবনে স্বপ্ন ভাঙার দিন; একটি কিশোরী মেয়ের জীবনে বাল্যবিবাহ চরম অভিশাপ ছাড়া আর কিছু না…’ —কথাগুলো বলছিল, ২০২০ সালে বাল্যবিবাহতে শিকার হওয়া কিশোরী পুস্পা আক্তার। যার বয়স বর্তমানে ১৭ বছর এবং তারই কোলে ৯ মাস বয়সি শিশু-২০২১ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—করোনা মহামারির মধ্যে দেশে বাল্যবিবাহ হয়েছে ৪৭ হাজার ৪১৪ শিক্ষার্থীর। এ সময় শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে ৭৭ হাজার ৭০৬ জন। ১১ হাজার ৬৭৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার ৫৫ জন শিক্ষার্থীর বার্ষিক পরীক্ষায় আর অংশ নেওয়া হয়নি। বাল্যবিবাহর কারণে শিক্ষার্থী অনুপস্হিতির হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহী অঞ্চলে, যা মোট ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। সিলেটে সর্বনিম্ন ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। শিশুশ্রমের কারণে শিক্ষার্থীর অনুপস্হিতির হার সর্বোচ্চ রাজশাহী।তের বছর বয়সি কিশোরী খালেদা। সপ্তম শ্রেণিতেই তার লেখাপড়ার ইতি টানতে হয়। কারণ হিসেবে জানায় পরিবারে অভাব। খালেদার বাবা অসুস্হ, তিনি ছিলেন দিনমজুর। কিন্তু করোনা মহামারিতে তিনি কাজ হারান। মায়েরও কাজ ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে গ্রাম ছেলে খালেদার মা বিলকিস বেগম, খালেদা ও তার পাঁচ বছর বয়সি ছোট বোন খাদিজাকে নিয়ে রাজধানীতে আসেন। সেখানে একটি ফ্ল্যাট বাসায় বাচ্চা দেখা-শুনার কাজ পায় খালেদা। বছরখানেক ঐ বাসায় কাজ করবে সে। তারপর বেতনের যে টাকা জমবে, তাই দিয়ে খালেদার বিয়ে হবে। কিন্তু খালেদা বিয়ে করতে চায় না; স্কুলে যেতে চায়। খালেদা বলে, প্রায় দিন স্বপ্নে দেখি, আমার বিয়ে হচ্ছে, আর আমি খুব কাঁদছি, এরপর চমকে উঠি, ঘুম ভেঙে যায়, তখন বুঝি, দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম।পুস্পা নবম শ্রেণির ছাত্রী। স্কুল, লেখাপড়া, ছোটদের সঙ্গে ছুটোছুটি, খুনশুটি আর ক্ষণে ক্ষণে ভাবির সঙ্গে দুষ্টুমিতে পূর্ণ ছিল তার প্রতিটি দিন। বছর দুয়েক আগে দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন বাবা-মাকে। বড় ভাই তার অভিভাবক। ভাই, ছোট বোনকে আদরও করেন যথেষ্ট। বোনের কোন চাহিদাই অপূর্ণ রাখেন না। এক সন্ধ্যায় লেখাপড়া শেষ করে টিভি দেখছিলেন পুস্পা। হটাত্ বড় ভাই বাইরে থেকে এসে টিভির সুইস অফ করে দিয়ে বলেন—‘নাটক দেখা বন্ধ, এখন পুস্পার বিয়ে’। এ কথায় বিপরীতে ১৪ বছরের কশোরীর আর কিছু বলার ছিল না। এখন কিশোরী পুস্পার কোলে ৯ মাস বয়সি শিশু। বর্তমানে পুস্পার বয়স ১৭ বছর।পুস্পা বলে, বিয়ের দিনের কথা মনে পড়লে এখনো শিহরিত হই। বিয়ের দিনটি আমার জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল। ভাইকে কিছুই বলতে পারিনি। আমার জীবনের কষ্টগুলো। আমি চাই—এমন না বুঝেই বিয়ে যেন কোন কিশোরীর জীবনে না ঘটে। এমন বিয়ে একটা মেয়ের জীবনে স্বপ্ন ভাঙার দিন। বাল্যবিবাহ একটা কিশোরী মেয়ের জীবনে চরম অভিশাপ। এমন বাস্তবতা শুধু খালেদা আর পুস্পার জীবনেই নয়, দেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ কিশোরীর জীবনের গল্প।পরিবার থেকে অভিভাবকরা মেয়ের নিরাপত্তা এবং নিশ্চিত জীবনের আশায় দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু মেয়েটা সেখানে ভালো থাকবে কি-না, তা গ্রামের অভিভাবকরা বুঝেও যেন বুঝতে চান না। বাল্যবিবাহর কুফল কমবেশি অনেকে জানেন, কিন্তু মানতে চান না। মাতুয়াইল শিশু মাতৃসদন হাসপাতালের পরিচালক ও গাইনি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. দিলরুবা আক্তার ইত্তেফাককে বলেন, প্রথমতম, কিশোরী বয়সে তাদের শরীর বিয়ের জন্য তৈরি থাকে না। তার পুষ্টির ঘাটতি থাকে। স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো হয় না। কিশোরী মেয়ে সে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ঠিকমতো নিতে পারে না, ফলে বিয়ের অল্প সময়ের মধ্যে সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এরপর কিশোরী মেয়ের বাচ্চা ধারণে নানা জটিলতা দেখা দেয়। বাচ্চা অ্যাপশন হয়ে যায়। পেটে ঠিকমতো শিশুর পুষ্টি হয় না। তার পেলভিস ডেভেলপ করে না। তার সিজার করতে গেলেও জটিলতা দেখা দেয়। ব্রেস্টফিডিং-এ সমস্যা হয়। কিশোরী গর্ভবতী মায়ের অ্যানিমিয়া দেখা দেয়, পুষ্টিহীনতায় ভোগে। মানসিকভাবে সে অসুস্হ হয়ে যায়। এসবের কারণে পরিবারে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়। মাতৃমৃতু্য এবং শিশুমৃতু্যর এটাও একটা কারণ বলে জানান তিনি।১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইন পরিবর্তিত হয় ২০১৭ সালে। সেখানে আইনটির নাম হয় ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭। ১৯২৯ এর ১৯ ধারা মতে, ‘কোনো পরিবার যদি ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়ে শিশুকে এবং ২১ বছরের নিচে কোনো ছেলেকে বিয়ে দেয়, তবে দুই মাসের কারাদণ্ড এবং ১ হাজার টাকা জরিমানা দেবে। অপরদিকে কোনো ব্যক্তি কোনো মেয়ে শিশুকে বিয়ে করলে বরের শাস্তি হবে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ মতে, কেউ যদি মেয়ের অভিভাবক বাল্যবিবাহ চুক্তি করেন, তাহলে দুই বছর বা ছয় মাস কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে।স্কুলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কুলশিক্ষক খন্দকার আসাদুজ্জামান বলেন, নিরাপত্তার অভাব আর দরিদ্রতার কারণে স্কুলের গণ্ডি পার হতে না হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় বহু কিশোরীকে। তাছাড়া একটি কিশোরীর বিয়ে দিয়ে পরিবারে একটি খাবারের মুখ কমাতে চান অভিভাবকরা। বাল্যবিবাহর কারণে অকালেই ভেঙে যাচ্ছে এসব শিক্ষার্থীর স্বপ্ন। যা তাদের জীবনে দুঃস্বপ্নই বটে। তবে বাল্যবিবাহর কুফল সম্পর্কে এখনো গ্রামের মানুষ ততটা জানে না। ফলে তাদের আমরা বোঝাতে পারি না। এ বিষয়ে প্রচারণা চালানো গেলে হয়তো বাল্যবিবাহ কমতে পারে।অন্য একজন শিক্ষক মাহবুবা আক্তার বলেন, সমাজে নারীর অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে পারলে এবং নারী ও শিশুর ওপর সব ধরনের সহিংসতা রোধ করতে পারলে বাল্যবিবাহর হার কমে আসবে। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার পেছনে নিরাপত্তাহীনতা একটি বড় কারণ। এছাড়াও অনেকে দরিদ্রতার কারণে স্কুল ছেড়ে দিয়ে বাবা-মার সঙ্গে কাজ করছে। করোনাকালে বাল্যবিবাহ বাড়লেও, আগের চেয়ে বাল্যবিবাহ অনেকাংশে কমেছিল।