মাঝ-রাত্রির স্বপ্ন এসে ঠেকলো বুঝি ভোরের শেষে; পুবআকাশে-
বুকের ভেতর বিরাট এক জলশূন্য মরুভূমি! সকল স্নেহের জল শুষে নিয়ে ক্রমশ বালির ঝড় ঢেকে দিচ্ছে আমায়। কিছু দূরে, দেখা যায় কী যায় না — একটা জলভরা কলস!
ওদিকটায় এগিয়ে যেতে চাই, কিন্তু পা যেন শক্ত শেকল দিয়ে কেউ বেঁধে রেখেছে। আমার খুব ঘুম পায়। ঘুমিয়ে যেতে যেতে অনুভব করি — বহুদূর থেকে কোলাহল ভেসে আসছে। কারও বুঝি আজ ‘গায়ে হলুদ’।
“কে তুমি তন্দ্রাহরণী– দাঁড়িয়ে আমার চোখের আগে ; রাঙালে মন অস্ত রাগে কে গো চন্দ্র বদনী…!”
মান্না দে’র গান কি ‘গায়ে হলুদে’র অনুষ্ঠানে কেউ গায়?
কী জানি! হয়তো শিল্পী এসেছে। মৌজ মাস্তি চলছে।
একটু এগিয়ে দেখতে পেলাম, ছোটো-খাটো একটা স্টেজে কন্যা একলাই বসে আছে। গা ভর্তি হলুদ গাঁদাফুলের গয়না। বাড়িতে মনে হয়, হুলস্থুল পড়ে গিয়েছে। কে যেন বললো, কন্যার মাকে জিনে ধরেছে। তিনি ঘন ঘন মূর্চ্ছা যাচ্ছেন। আর ওদিকে দূর্বৃত্তরা থানা আক্রমন করেছে। কন্যার বাবা সেখানে ডাকাত সামলাচ্ছেন।
কী টাইমিং রে বাবা!
এ কোন যন্ত্রণার বাড়িতে এসে পড়লাম। হা হতোস্মি!
কন্যার মুখ ভয়ে আতঙ্কে এতটুকুন হয়ে আছে।
মুখটি তোলো গো কইন্যে! চাঁদমুখ দেখে প্রাণ ঠাণ্ডা করি। ওমা! কন্যার মুখে যে আমার মুখটি বসানো! আমিই কি তবে? না, না– ভয়ের চোটে চোখ কচলে ধড়মড় করে উঠে বসলাম।
মাঝরাতে কী এক বিশ্রী স্বপ্ন রে বাবা! মোবাইল অন করে দেখি, রাত সাড়ে চারটে। আজান হতে এখনো আরও আধঘন্টা বাকি। সাইডটেবিলে রাখা জগ থেকে ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে জল পান করি। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের নক্ষত্র দেখি। ওখানে কি বাবা আছে, মা-ও?
ওঁরা কি আমায় দেখছেন? ওঁরা কি জানে, প্রতিরাতে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ওঁদের খুঁজি?
সারা বাড়িতে আমি একা। কেমন যেনো ভয় ভয় লাগছে। তাড়াতাড়ি আবারও এসে খাটে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ি। আর কি ঘুম আসবে?
গায়ে হলুদ দিতে এসে মা কেমন বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালেন। তরুণী বয়সের মাকে আমার দারুণ রূপবতী রাজকন্যা মনে হয়। মাথাভর্তি এক ঢাল কালোচুল। কালো ডাগর আঁখিতে কত যে হাসি লুকানো! কিন্তু মা আমাকে হলুদ না ছুঁইয়েই তিনি ভুলভুলাইয়া ছবির মঞ্জুলিকারূপী বিদ্যা বালানের মতো অপ্রকৃতিস্থ চোখে তাকান। তাকিয়েই থাকেন। যদিও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু আমাকে দেখছেন না। তার দৃষ্টি আমাকে ভেদ করে দূরে কিছু দেখার চেষ্টা করছে।আমি শুনতে পাই, মা স্বগতোক্তি করে বলছেন, এখনই থানায় ডাকাত পড়বে। ওরা দাগী আসামি।
আমাদের বাসায় কাজ করে একজন লম্বা চওড়ামত লোক। লোকটির নাম আমরা জানি না। যেহেতু লোকটি কথা বলতে পারতো না। সে ছিলো জন্মবোবা। তাই তার নামই হয়ে গিয়েছিলো, বোবা। সবাই তাকে বোবা বলেই ডাকতো। সেই বোবা এসে খবর দিলো, (ও ইশারায় চমৎকারভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতো। আমরা সবাই ওর ইশারা সংকেতের কথা বুঝতে পারতাম। মা আরও বেশি বুঝতে পারতেন।) থানায় আক্রমণ হয়েছে। আব্বাও থানায়ই আছেন।
খবরটা শুনেই মা মাথা ঘুরে আমার কোলের ওপরই মূর্চ্ছা গেলেন। আমার গায়ে হলুদের মঞ্চ করা হয়েছে বারান্দায়। মাকে সবাই ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেলো। আমি একা স্টেজে বসে আছি। কণের নাকি হলুদের মঞ্চ ছেড়ে উঠতে নেই। আমার মন ছটফট করছে। আমি মায়ের কাছে যাবো। নানীজান এসে বললেন, কণের চোখের জলে অমঙ্গল হয়। আয় আমার সাথে আয়।
ঈশ্বরদীর এই বাড়িটা বিশাল বড়। এঘর ওঘর করে অনেকগুলো দরজা। মূল ফটক পেরিয়ে বাড়ি। বাড়ির ভেতর শানবাঁধানো উঠান। আবার এই বাড়ির খিড়কি দরজা দিয়ে পিছনে গেলে অনেক বড় বাগান। বাগানে বসার বেঞ্চও আছে।
নানীজানের সাথে কত পথ যে পেরিয়ে এলাম!
বেঞ্চের মধ্যে ধপাস করে বসে পড়ে বললাম, কোথায় নিয়ে এলে? মা কই? আমি মা’র কাছে যাবো।
নানীজান আমার পাশে বসলেন। যেনো তিনি মন্ত্র পড়ছেন, এমনভাবে রহস্যময় গলায় বললেন, বিয়েটা করিস্ না বুন্ডি! ঘোর অকল্যাণ হবে! তোর মায়ের জিন সতর্ক করতে আসছে। তোর নানাজান ছিলেন বড় কামেল মানুষ। তিনির মৃত্যুকালে তিনি তাঁর পালিত একটা জিন তোর মা’র জন্য মোতায়েন করে গ্যাছে।
আমার চোখে ভেসে এলো হবু বরের ছবি। রাঙা টুকটুকে বর আমার! এঁকে বিয়ে না করলে তো আমি মনে হয়, মরেই যাবো। দুনিয়া ইধার কী উধার; ইয়ে হামারা বর চাহিয়েই চাহিয়ে…!
নানীজানের সবকথা না শুনেই শাড়ি সামলে পড়িমরি ছুটতে ছুটতে এসে কণের স্টেজে ঠাস করে বসে পড়ে হাঁপাতে লাগলাম। বড়দিভাই এসে কষে ধমক লাগালেন। হলুদের দিনেও তোমার ধেই ধেই করে সারাবাড়ি নেচে বেড়াতে হবে, না? ওদিকে বরের ভাবি স্টেজে তোমাকে না পেয়ে কতগুলো মিঠেকড়া কথা আমাকে শুনিয়ে দিলো।
আমি যেনো আকাশ থেকে পড়ে গেছি এমনভাবে বললাম, ওমা! ওরা আবার কখন এলো? মা কেমন আছে? নানীজানই তো আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো।
বড়দিভাই চোখ পাকালো।
ফের মিথ্যে কথা! নানু তো মায়ের কাছে বসে সেই তখন থেকেই কোরান পড়ছেন। আর মা’র চিন্তা আছে তোমার?
দিব্যি দিয়ে কিছু বলতে গেলাম। কিন্তু হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজন এসে পড়ায় তাড়াতাড়ি লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের মতো মাথায় ঘোমটা টেনে বসে পড়লাম। ওরা ঢাকা থেকে ফটোগ্রাফার নিয়ে এসেছে। নানান কায়দায় ছবি তোলা হতে থাকলো। ফটোসেশান আর শেষই হচ্ছে না।আমার মনটা আকুলিবিকুলি করছে একটুখানি মাকে দেখার জন্য। একটুখানি বাবার মুখটা দেখার জন্য। তর সইছে না।
আমি চিৎকার করে ডাকলাম, বাবা! বাবা! মা! মা!
কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। শুধু ঢাকা শহরের রাস্তায় রাতের শেষ প্রহরে সারমেয়গুলো তারস্বরে ডাকছে। আধেক ঘুমে আধেক স্বপ্নে গভীর শূন্যতা নিয়ে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে অভিমানীকণ্ঠে বললাম, স্বপ্নেও কি দেখা দিতে পারো না, বাবা? কতই না ভালো বাসতে আমায়? এই কি তার নমুনা বাপজান?
“ধীরে ধীরে সে মেরে জিন্দেগী মে আ না…
ধীরে ধীরে সে দিল্ কো চুরানা…!
ধুমসে গান বাজছে। “মালকা বানুর দ্যাশে রে
বিয়ার বাদ্য বাজনা বাজে রে…!”
বর এসেছে! বর এসেছে!
আমিও চরম উত্তেজনা চেপে রেখে বড়দিভাইকে বললাম, একটু দেখে আসি? কী সুন্দর লাগছে, না রে? একদম রাঙা টুকটুক!
দাদীজান পান খাওয়া লাল ঠোঁটে হাসি বিস্তৃত করে বললেন, মিয়ার (মেয়ের) আহ্লাদী বর আইছে গো!
কিন্তু গেটে বিশাল হট্টগোল লেগে গেলো। ছোট ছোট ভাইবোনেরা গেট ধরেছে। কিন্তু বরপক্ষ কোনো টাকা দেবে না। এই নিয়ে তুমুল বচসা চরমে উঠলে বাবার ধমক খেয়ে সবগুলো ছেলেমেয়ে পালালো। আমার এতক্ষণের আনন্দ দপ্ করে নিভে গেলো। গেট ধরা, ফিতা কাটা, শরবত খাওয়ানো, বিনিময়ে টাকা দেওয়া, এতো অনেক আগে থেকে চলে আসা রীতি। এখানে এই অপ্রীতিকর বিষয়টি আমার কাছে সুখকর ঠেকলো না। আমার সাজানো উজ্জল মুখটায় অন্ধকার নেমে এলো।
বরপক্ষকে বসারঘরে বসানো হয়েছে। তাদের সমাদরের কোনো ত্রুটি হলো না।গোল বাঁধলো, কাবিনের টাকার অঙ্ক নিয়ে। বরের বড় বোনের উচ্চকিত কণ্ঠ ভেতরের ঘর থেকেও শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, যেনো রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের লাইভ চলছে। সোনার গয়না কত ভরি, আরও কী কী হিসাব…! বরটি রুমাল মুখে দিয়ে জড়বৎ পুতুল!
এবার আমার ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। চিৎকার, চেঁচামেচি শুনে সবাই আমাকে রেখে বসার ঘরে চলে গিয়েছে। ( চলিতেছে সার্কাস!)
দাদীজান এসে বললো, পানি খাবা, দাদু?
আমি কোনোমতে মাথা নাড়লাম। দাদীজান আমাকে ওখান থেকে টেনে এদিকে নিয়ে আসলেন। আমিও ভাবলাম, এগুলো না শ্রবণ করাই আমার কর্ণের জন্য উত্তম। দাদীজানের সাথে সাথে পিছনের বাগানে এসে সেই একই বেঞ্চিটাতে বসলাম। (গায়ে হলুদের দিনে যেখানটায় বসেছিলাম।) দাদীজান কোমল কণ্ঠে বললেন, এ বিয়ে ভেঙে দাও দাদু। তোমার বিবাহ। তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ বিয়ে তোমার জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
দাদীজানের কথা শুনে আমি আৎকে উঠে ভাবলাম, এ বিয়ে ভেঙে গেলে বাবার মানসম্মানের ধ্বজা উড়ে যাবে। না, না…!
দৌড়ে পালিয়ে ঘরে এসে নিজেকে প্রাণপনে সামলাচ্ছি। বাবা, মা, আত্মীয় স্বজন একজন হুজুরসহ মোটামুটি সবাই তখন এই ঘরে এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।আমি চোখ ঘুরিয়ে দাদীজানকে খুঁজলাম। নানীজানকে খুঁজলাম। তাঁরা কেউই ওখানে নেই। কেউ কেউ আমার পাশে বসে পড়েছে। মানে হলো, এখন আমার এজিন ( সম্মতি) নেবে। হুজুর বললেন, মা বলো, ক্ববুল!
ক্ববুল বলতে গিয়ে আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
মা আমার হাত ধরে সাহস দিয়ে যেনো বলতে চাইলেন,
মা গো! ভয় নেই, আমরা আছি।
বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে অভয় দেওয়া কণ্ঠে বললেন, ভয় নেই, মা। আমি আছি। সবসময় আছি, থাকবো।
বাবার এমন স্নেহপূর্ণ কথায় আমার কান্না যেনো সাত সাগরের জলেরমতো উথলে উঠলো। বাবা! বাবা!
কোথাও বাবা নেই। মা নেই। ভাই নেই। বোন নেই। পুত্র নেই। কন্যা নেই। প্রেমিক নেই। স্বামী নেই। কেবল এক আকাশ শূন্যতা ক্রমশ গ্রাস করছে আমায়! স্নেহহীন এক চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছি, তলিয়ে যাচ্ছি…
কেউ বুঝি ডাকলো। ওঠো!ঘুরে দাঁড়াও! এভাবে তলিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই। মানুষের একটাই জীবন। একবারই মরে। আর যে মরার আগে বারবার মরে, তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না।
ভোরের আকাশে সুবহে সাদিকের রহস্যময় আলো। ওই আকাশের তারায় তারায় বাবা আছেন, মা-ও আছেন। নিশ্চয়ই ভালো কিছু অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
কোন বা পথে-
সালমা খানম,
কবি, গ্রন্থ প্রণেতা, রেডিও অনুষ্ঠান উপস্থাপক ও নিয়মিত লেখক : আলোকিত চকরিয়া ডট কম