ধূমকেতু নামে একটি পত্রিকা কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদনা করেন ১৯২২ সাল নাগাদ। ১২ আগস্ট ১৯২২ তারিখে ‘ধূমকেতু’র প্রথম সংখ্যাটি আত্মপ্রকাশ করে। এই পত্রিকাটির প্রকাশের ‘রকম’ ছিল, এটি সপ্তাহে দু দিন করে বার হতো। মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন, “‘ধূমকেতু’-র সারথি (সম্পাদক) ও স্বত্বাধিকারী ছিল কাজী নজরুল ইসলাম। তার কর্মসচিব (ম্যানেজার) ছিল শ্রী শান্তিপদ সিংহ। কাগজের মুদ্রাকর ও প্রকাশক ছিলেন আফ্জালুল হক সাহেব।”ভারতের ‘পূর্ণ’ স্বাধীনতার কথা দাবি হিসেবে প্রথম উত্থাপন করে ধূমকেতু। নজরুল পত্রিকার পৃষ্ঠায় অত্যন্ত স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লেখেন, ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেন না, ও-কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসন-ভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোন বিদেশীর মোড়লী অধিকারটুক পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাঁদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা পুটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু দূর করতে হবে।’
এই কথা কখন বলছেন নজরুল? যখন গান্ধীজি বলছিলেন যে, ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’ পেলেই তিনি ‘ইউনিয়ন জ্যাক’ (ব্রিটিশ পতাকা) উড়িয়ে দেবেন। এই যখন অবস্থা, যখন শ্রী অরবিন্দ ঘোষও শুধু ‘অটোনমি ও সেলফ্ গবর্নমেন্ট’-এর দাবি তুলছেন—কোথাও তাঁর লেখায় ‘ইন্ডেপেন্ডেন্স’ শব্দটি ব্যবহার পর্যন্ত হচ্ছে না—এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সারা জীবন ধরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী কেবলই ‘অটোনমি ও সেল্ফ গবর্নমেন্ট’-এর দাবি করে গেছেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে নজরুলের স্বাধীনতাবোধের আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ ও তাঁর চিন্তাশক্তির অগ্রবর্তিতার কথা আগামীকাল তাঁর জন্মদিনে ভেবে দেখতে হবে সকল বাঙালিকে। এ প্রসঙ্গে বিপিনচন্দ্র পালের কথাও উল্লেখ করেছেন মুজফ্ফর আহ্মদ। শ্রী পালও কোথাও ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেননি। তিনি কী বলেছিলেন? বলেছিলেন, ভগবান যদি একইসঙ্গে ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস ও পূর্ণ স্বাধীনতা (complete Independence free from all foreign control) তাঁর হাতে এনে দেন তবে তিনি ‘ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস’কেই বেছে নেবেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নজরুলই প্রথম বাঙালি, যিনি বৈঠকখানায় খোশহালে বসে দেশের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলে আলাপচারিতা করছেন, এমনটি মোটে নয়, বরং তিনি জীবনের পুরোপুরি ঝুঁকি নিয়েই একা প্রকাশ্য দাবি তুললেন।
চিন্তার অগ্রবর্তিতার জন্য অনেক সময় অতি-অদম্য বিপুল এক সাহসিকতারও দরকার হয়। যা নজরুল-চরিত্রে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। এই বাংলায় এমন দু-চারিটি লেখক পাওয়া যায় যাঁরা রবীন্দ্র-নজরুলের চরিত্রের ছিদ্রান্বেষণ করে লেখা বা উপন্যাস ফাঁদেন; যেখানে এই দুই মহান ব্যক্তির চরিত্রের ছিদ্র পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে এই লেখকরা দরকার মতো ছিদ্র তৈরি করে নেন। ছিদ্র তৈরির পর বলেন, এই তো ফুটো পাওয়া যাচ্ছে। এঁদেরই একজন একবার এক বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকায় নজরুলের যৌন-রোগ ব্যাপারে প্রবন্ধ লিখে বাহবা পেয়েছিলেন। এই এঁরা পিকস ডিজিজকে লেখেন সিফিলিস। রবীন্দ্রনাথেরও উক্ত যৌনব্যাধি আছে বলে প্রচার-নিনাদ করেছিল একদা একটি ভুঁইফোড় পত্রিকা। এই খবরও উক্ত সাপ্তাহিকে উল্লেখ করে নিবন্ধ রচনা করা হয়েছিল। কথা তো সত্যই যে জোড়া লাথির ঘায়ে পাপোশে রবীন্দ্র রচনাবলী ছড়িয়ে ফেলার মতো প্রতিভাও এই বাংলায় অনায়াসে জন্মায়।আসল কথায় ফেরা যাক। চিন্তা ও সৃজন-প্রতিভায় নজরুলের অগ্রবর্তিতার ব্যাপারে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে এই বাংলায়। নজরুল সমন্বয় ভাবনার ভারতীয় পথিকৃত্। তিনি যা আগে ভেবেছেন, তাই-ই পরে ভাবতে হয়েছে বাঙালিকে।কিছু ব্যাপারে নজরুলের রয়েছে আশ্চর্য অপূর্বতা। সে কথা এই বেলা সর্বান্তকরণে কবুল করা চাই। যেমন তাঁর বাংলা গজলের অপূর্বতা, তেমনই তাঁর সমন্বয় ভাবনার বিশিষ্টতা এবং আপসহীন বিদ্রোহী-সত্তার একত্ব। যিনি আপনারে ছাড়া কারুকে কুর্নিশ করতে জানতেন না। সে-ও এক অপূর্ব বিস্ময়!