২০২৩ সালে সারা দেশে ৪০০টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৪২ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর এসব ঘটনায় ৪ হাজার ৭৭১ জন আহত ও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। একইসঙ্গে বিদায়ী বছরে মুখোশ পরে গুপ্ত হামলার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন ঘটনারও আবির্ভাব হয়েছে। রাতে বা নির্জন রাস্তায় এসব ঘটছে। যার শিকার হচ্ছেন বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা।এছাড়াও রাজনৈতিক সহিংসতা, হানাহানি এবং বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দায়ের ও এসব মামলায় তাদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি সাজা দেওয়ার ঘটনাও বেড়েছে।রোববার রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৩: এমএসএফ-র পর্যবেক্ষণ‘ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিষ্ঠতা সভাপতি সুলতানা কামাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। মানবাধিকারের কথা তুললে সরকার বিরক্ত হচ্ছে। যারা মানবাধিকারের কথা বলছেন, তাদের বৈরিতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র ও মানবাধিকারকর্মীদের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে। দেশের গত এক বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানবাধিকারের প্রতি সম্মান করা, সুরক্ষা দেওয়া এবং মানবাধিকারবোধ বাস্তবায়ন করা। গত এক বছরে এসব ব্যাপারে রাষ্ট্র মনোযোগী ছিল না। যখনই মানবাধিকারের কথা উঠেছে, তারা আত্মরক্ষামূলক কথা বলেছে। তিনি আরও বলেন, মানবাধিকার সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মানবাধিকারের প্রতি সম্মান করা হয়নি। মানবাধিকারবোধ সঞ্চারে সরকার বুদ্ধিবৃত্তিক পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারের আচরণ দেখলে মনে হয়, মানবাধিকারের বিষয়গুলো তারা গুরুত্বপূর্ণভাবে নিচ্ছে না।সরকার মনে করছে, শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন হলেই যথেষ্ট। মানুষের মনমানসিকতা, মানবাধিকারবোধ উন্নয়নে যেন তাদের দায়িত্ব নেই, বলেন তিনি মানবাধিকার ইস্যুতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সুলতানা কামাল বলেন, ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি, তাদের অন্তর্নিহিত অনেক দুর্বলতা রয়েছে। যেখানে মানবাধিকার ইস্যুতে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা সর্বজনগ্রাহ্য নাগরিক ব্যক্তিত্বদের, সেখানে বছরের পর বছর নেতৃত্বে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক যে ব্যবস্থাপনা, তাদের যে জনবল, তাদের যে তদন্ত করার ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এ কমিশনের কাজগুলো হওয়ার কথা প্যারিস প্রিন্সিপালের আলোকে, তবে প্যারিস প্রিন্সিপালের নীতিগুলো ফলো করা হয়নি। এ কারণে আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী, স্বাধীন কমিশন তৈরি করতে পারিনি।সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংগঠনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আইনজীবী সাঈদুর রহমান। এসময় সংস্থাটির সমন্বয়ক মো.টিপু সুলতানও উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার সুরক্ষায় ১৫ দফা সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে।সংস্থার ১৫ পৃষ্টার ১৫টি বিষয়ভিত্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দু্ই মাসে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১২৪টি গায়েবি মামলা হয়েছে। যাতে দুই হাজার ৮০৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাজনৈতিক ডামাডোলে নারী,শিশু ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাও ক্রমকর্ধমান হারে বেড়েছে। ২০২৩ সালে ৬২৩ নারী ও ৭৬৮ শিশু ও কিশোরী যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ২৩১টি, দলগত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৪৯ নারী। এছাড়াও ৭২ জন প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বিদায়ী বছরে নির্বাচনি সহিংসতার ১৩৮টি ঘটনায় ১০ জন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে মুখোশ পরে গুপ্ত হামলার ঘটনায় তিন জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া ২০২৩ সালে বিচারবহির্ভূত ক্রসফায়ারের ১৬টি ঘটনায় ৭ জন নিহত হন। একই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী কর্তৃক অপহরণের অভিযোগ এসেছে ৮৯টি। এ বছরে পুলিশ হেফাজতে ১৭ জন, কারা হেফাজতে ১৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে অজ্ঞাতনামা ৩৫২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ী বছরে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ৬২টি। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন ৬৩ জন। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে ২৭ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৩২ জন। তবে এ বছর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা কমে এসেছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৮১, এ বছর তা নেমে এসেছে ৬৩-তে।তথ্যানুযায়ী বিদয়ী বছর পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩১৩ জন সাংবাদিক। তাদের মধ্যে নিহত হয়েছেন ১ জন, আহত হয়েছেন ১৫২ জন, লাঞ্ছিত হয়েছেন ১০৭ জন ও আইনি হয়রানির শিকার হয়েছেন ৫৩ জন সাংবাদিক। ১১ টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, ১ টি সাইবার নিরাপত্তা আইনে এবং ১১টি মামলা হয়েছে ফৌজদারী ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ১০ জন সাংবাদিক। এছাড়াও ৫২ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় রাজনৈতিক সংঘর্ষের মধ্যে পরে আহত হয়েছেন ।