মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনের ৬ বছর আজ। দিনটিকে রোহিঙ্গারা কালো দিবস আখ্যা দিয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এ উপলক্ষে আজ শুক্রবার (২৫ আগস্ট) সকাল ১০টার দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘হোপ ইজ হোম’ ক্যাম্পেইন পালন করেছে রোহিঙ্গারা।রোহিঙ্গা গণহত্যার ৬ বছর পূর্তির উপলক্ষে রোহিঙ্গারা দিবসটি পালন করে। তারা সেখানে মিয়ানমারে গণহত্যার বিচার, দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন।দাবিগুলো হলো- মিয়ানমারে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, সীমিত সময় রাখা যাবে মিয়ানমার ট্রানজিট ক্যাম্পে, সকল রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিজস্ব সহায়-সম্বল ফেরত, প্রত্যাবাসনের সময় বেঁধে দেওয়া, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন, একসঙ্গে গ্রামের সব মানুষকে প্রত্যাবাসন করা ও রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে উত্থাপন না করা। এছাড়া প্রত্যাবাসনে প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন ও বাংলাদেশসহ দাতা সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করা।‘হোপ ইজ হোম’ ক্যাম্পেইন উপলক্ষে আশপাশের ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গারা কুতুপালং খেলার মাঠে জড়ো হয়। ক্যাম্পেইন সমাবেশে পুরুষদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরাও যোগ দেয়। এ সময় পোস্টার, প্ল্যাকার্ডেরোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার দাবি তুলে। রোহিঙ্গা ঢলের ৬ বছরে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবসের সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার শোয়াইব, মাস্টার নুরুল আমিন, মাস্টার জুবায়ের, মোহাম্মদ ইউসুফ, রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী সৈয়দ উল্লাহ, মাস্টার কামাল প্রমুখ।আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। আমরা এই গণহত্যা দিবসে পালন করছি। কারণ এদিনে মিয়ানমার জান্তা সরকার আমাদের ওপর জাতিগত গণহত্যা চালিয়েছে। এই দেশে আর কত বছর থাকবো। আর থাকতে চাই না। আমরা স্বদেশে ফিরতে চাই’।সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যানারে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী সৈয়দ উল্লাহ বলেন, মিয়ানমার আমাদের দেশ, অনতিবিলম্বে আমাদের নিজ দেশে ফেরত নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই, আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে প্রত্যাবাসন সফল করতে দেশটির পাশে থাকতে হবে’। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশটির সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলের মংডু, বুচিদং ও রাসেথং জেলার রোহিঙ্গাদের ওপর নির্বিচারে হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। সে সময় প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। ওই দিনটিকে স্মরণে টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা রোহিঙ্গা জেনোসাইড রিমেম্বার ডে পালন করে আসছে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধন শুরু করলে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত অতিক্রম করে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। এর আগেও কয়েক দফায় আসা রোহিঙ্গা মিলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন সাড়ে ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাস। ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও বাড়িঘর পুড়িয়ে রাজ্যজুড়ে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি করেছিল মিয়ানমার বাহিনী।প্রাণ বাঁচাতে নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এসব রোহিঙ্গা। পরে তাদের ঠাই হয় উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ের ৩১টি ক্যাম্পে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরে তাদের প্রত্যাবাসনের কয়েক দফা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমারের টালবাহানা ও রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন শর্ত-অজুহাতে বার বার আটকে যায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। ২০১৮ সালে প্রত্যাবাসনের নির্ধারিত দিনে সব ধরনের প্রস্ততির পরও তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গারা হঠাৎ মত পাল্টালে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। পরের বছর ২০১৯ সালেপ্রত্যাবাসনের দ্বিতীয় উদ্যোগও বিভিন্ন অজুহাতে ভেস্তে গেছে। তখন রোহিঙ্গারা দেশে ফিরতে পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছিল। এরপর এ বছরের শুরুর দিকেও বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে। এর আওতায় ১১৪০ জন রোহিঙ্গাকে প্রথম পর্যায়ে প্রত্যাবাসনে সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। এতে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিসহ ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের রাখাইনে প্রস্তত করা গ্রামগুলো পরিদর্শনেও যায়। তবে শেষ মুহূর্তে ওই প্রক্রিয়াও ভন্ডুল হয়।রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড ও বিশৃঙ্খলায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাত রয়েছে বলে আমরা শুনেছি। ইয়াবা ব্যবসায় যুক্ত রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সোর্স হিসেবে কাজ করছে। আমাদের দাবি যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন, মিয়ানমারের বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন বাতিল, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।এছাড়া প্রত্যাবাসনের পর আইডিপি ক্যাম্পের পরিবর্তে নিজস্ব গ্রামে ফিরে যাওয়ার সুযোগ ও বসবাসের পরিবেশ হলে আমরা স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে প্রস্তত।৮-আমর্ড পুলিশের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর (বিপিএম) বলেন, ‘আজ রোহিঙ্গাদের গণহত্যা দিবস উপলক্ষে তারা একটি সমাবেশ করেছে। তাদের এই সমাবেশ ঘিরে পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে’।