“নারীটি বিধবা, আবারও বিয়ে করেছেন। এবার ডিভোর্সী। গোটা তিনেক ব্যর্থ প্রেম নিয়ে এখন কিছুটা থিতু হবার আশায় ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর ভেতর প্রেমের ছলনায় মোহরের খোঁজে নিপুণ শিকারী হয়ে উঠেছেন। পুরুষটিও কম শাতেল নয়। সে-ও জানে, এই যৌবনবতী নারীর রসটুকু বোঁটা থেকে ছিবড়ে নিতে কতটা রসদ দরকার। হা হা হা!গতকাল নারীটির চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছিল পুরুষটির শার্টের আস্তিনে। অশ্রুর অভিনয়ে সিক্ত হয়ে সবটা যে ছলনা তা জেনেবুঝেও পুরুষটি আস্তে করে জানতে চেয়েছিল, কত? নারীটি আধবোজা চোখে কামনা ঢেলে বলেছিল,আপাতত দেড় কোটি।ঠোঁটে আর চোখের পাতায় এই নারীর এত যে কামনার ঢেউ ; পুরুষের সাধ্য কী তাকে উপেক্ষা করে! পুরুষটি তাই সবটুকু রস আস্বাদন করতে পঞ্চাশ লাখে রফা করে চলে এসেছিলো। কিন্তু আবারও ফিরে গিয়ে নারীটিকে স্নানঘরে আবিষ্কার করে সিক্ত হয়েছিল প্রেমরসে। নারীটির একটা নাম দেওয়া দরকার। কী নাম দেওয়া যায়? বুলবুলি? নাহ! পাখির নামে নাম মেয়েগুলো সাধারণত বোকাসোকা কিসিমের সরল হয়। কামদেবের আশীর্বাদপুষ্ট, সিক্ত বসনা নারীটি মোটেও সরল নয়। যে কোনো কলাবতী নারীর চেয়েও লক্ষগুণ সুচতুর। সুচারু দেহসৌষ্ঠবের অধিকারীনী আর মদন কলায় চৌকস। রম্ভা বললেও কম বলা হয়।”এতটুকু পড়া শেষ করে মুনিয়া তানভীরের কালো ডায়েরিটা বন্ধ করে ভাবতে থাকে, তানভীর কাকে নিয়ে এসব কথা লিখেছে? মনের ভেতর হু হু করে ঝড় বয়ে যায়। তাহলে কি তানভীর অন্য নারীতে মজলো? আজ তানভীর ভীষণ অন্যমনস্ক ছিল। তাড়াহুড়ো করে চলে যাওয়ার সময় সাথে থাকা ছোটো ব্যাগটা ড্রইংরুমের সেন্টার টেবিলেই ফেলে রেখে গিয়েছিল। ওখান থেকেই কালো ডায়েরিটা নিয়ে তীব্র কৌতুহলে পড়া শুরু করে মুনিয়া। মোবাইলে একটা কল পেয়ে তানভীর এই বাসার শোবার ঘরের খাট লাগোয়া একটা লেখার টেবিলের ড্রয়ারে কী যেন খুঁজছিল। জানতে চাইলে স্বগতোক্তি করে বলেছিল, পঞ্চাশ লাখ টাকা কোথায় রাখলাম! খুঁজে পাচ্ছি না কেন? তানভীরের সাথে মুনিয়ার সময়টা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। বিয়ের কথা বলাতে প্রায় প্রতিদিনই মন কষাকষি চলছে। অথচ গতমাস থেকে পিরিয়ড বন্ধ। মুনিয়া নিজের ভেতর যেন আরেকটা প্রাণের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে।মোবাইলটা বাজলো। তানভীরের কল। একি! এমন অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তি করছে কেন তানভীর ওর সাথে ? মুনিয়ার গলা কান্নায় বুঁজে আসে। ওর অভিযোগের প্রেক্ষিতে মুনিয়া বারবার কাকুতি মিনতি করে বোঝাতে চায় যে, না– ও পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ড্রয়ার থেকে নেয়নি। কিন্তু তানভীর মুনিয়ার কোনো কথাই বিশ্বাস করছে না।উপরন্তু, যা ইচ্ছে তাই বলে ওকে দেদারসে গালি দিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, যেমন করেই হোক মুনিয়া যেন ওর পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে দেয়; নইলে বিপজ্জনক কিছু একটা সমস্যা হবে এমনটা বলে শাসাতে থাকে। মুনিয়া অনাগত বাচ্চার কথা বলতে গেলে তানভীর কর্কশভাবে সন্তানের বিষয়টি অস্বীকার করে। এ-ও বলে, মুনিয়া এই কথা কাউকে বললে ওকে প্রাণে মেরে ফেলবে।বহুদিন পর মুনিয়ার বাবার কথা মনে পড়ে। মায়ের কথা মনে পড়ে। এই প্রথম সে মা এবং বাবাকে হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়ে। অভিমানে অনেকক্ষণ বোবা হয়ে পড়ে থাকে।গুলশানের এই আলীশান ফ্ল্যাটে আজ ওর খুব, খুউব–একা লাগে। এই বিশ্ব সংসারে নিজেকে একা আর অসহায় মনে হয় ওর। সত্যি বলতে আপন বলতে ওর তো তেমন কেউ নেইও। রাত গভীর হচ্ছে। ওর ঘুম আসে না। ডায়েরীর ওই রহসয়ময়ী নারী, তানভীরের সন্তানকে অস্বীকার, মেরে ফেলার হুমকী এবং চুরির অপবাদ সবটা কেমন যেন এক অশনি ষড়যন্ত্রেের আভাস দিচ্ছে। ওর আঠারো বছরের আবেগী অপরিণত মস্তিষ্ক সূত্র মেলাতে পারে না। কেবলই মনে হয়, তানভীর ফিরে আসবে।দরজার লক খুলে কেউ একজন ভেতরে প্রবেশ করলো। ওর ভেতর আশার আলো দপ করে জ্বলে ওঠে। নিশ্চয়ই তানভীর এসেছে। এই ফ্ল্যাটের একটা চাবি মুনিয়ার কাছে আছে। আর একটা তানভীরের কাছে রয়েছে। মুনিয়া চোখের জল মুছে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত শরীরটা টেনে তুলে ডাইনিং স্পেসে এসে দেখলো, তানভীর না, দাঁড়িয়ে আছে তানভীরের পোষা। কী যেন নাম লোকটার? ও কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে — চাবি কোথায় পেয়েছে জানতে চায়। পোষা জানায়, সে মুনিয়াকে নিতে এসেছে। তানভীর পাঠিয়েছে। মুনিয়ার হঠাৎই খুব জলপিপাসা পায়। ও ফ্রিজ থেকে কোমল পানীয়ের বোতল বের করে গ্লাসটা ঠান্ডা পানীয় দিয়ে পূর্ণ করে।এমন সময় শোবার ঘরে রাখা মোবাইলটা বাজে। মুনিয়া গ্লাসটা রেখে পা টেনে টেনে শোবার ঘরে মোবাইলের কল রিসিভ করতে গিয়ে দেখে, তানভীরের কল! কলটা ধরতে একধরনের বিবমিষা হয় ওর। কলটা কেটে দিয়ে মুনিয়া বড় আপুকে কল করে জানায়, বড় বিপদে আছে ও। মারাও যেতে পারে।মুনিয়া কেমনযেন এক অদ্ভুত ভয়ের গন্ধ পায়!পোষা ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ওকে দেখছে। মুনিয়া ফিরে এসে পোষাকে একদম পাত্তা না দিয়ে পানীয়টুকু গলধকরণ করে সাফ জানিয়ে দেয়– ও কোথাও যাবে না। পোষাটাকে ফিরে যেতে বলে। মুনিয়ার ভীষণ গা গুলিয়ে ওঠে। ওর একবার মনে হয়, এসিডিটি। আবার মনে হয়, ও যখন মোবাইল ফোনে শোবার ঘরে গিয়ে কথা বলছিলো, তখন পোষাটা কোমল পানীয়ের সাথে চেতনানাশক কিছু মেশায়নি তো!। কিছু বুঝে উঠবার আগেই মাথা ঘুরে ও মেঝেতে পড়ে যায়। তড়িৎগতিতে পোষাটা মুনিয়ার বুকের ওপর চড়ে বসে। ও প্রাণপনে চোখ খুলে লোকটাকে ঠেলে সরাতে চায়। হঠাৎই ভুত দেখার মতো চমকে ও খেয়াল করে, তানভীর এবং পোষাটা ওর গলায় চাপ দিচ্ছে।তানভীর কখন এলো? নাকি ও আগে থেকেই পোষাটার সাথে এসে ড্রইংরুমে লুকিয়েছিল সুযোগের অপেক্ষায়? ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে মুনিয়ার কেমন নিস্তেজ লাগে।কিন্তু হঠাৎই ওর শরীরটা ফড়িংয়ের মতো হালকা হয়ে যায়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মুনিয়া অবাক হয়ে লক্ষ্য করে,ওরা ওর প্রাণহীন শরীরটা টেনে নিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিচ্ছে। মুনিয়া ভয় পেয়ে দরজা খুলতে গিয়ে অনুভব করে, ও দরজা খুলতে পারছে না। বাতাসে ভেসে ভেসে তানভীরের কাছে গিয়ে মুনিয়া তানভিরকে ধরে ঝাঁকাতে থাকে। কিন্তু তানভীর মুনিয়াকে দেখতে পায় না। মুনিয়া বুঝতে পারে, কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। ও ভাবে, তাহলে কি ওর মৃত্যু হয়ে গিয়েছে? এখন কি তানভীর এই হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবে? ওর পক্ষে সব সম্ভব।ওর অসীম ক্ষমতা। এর আগেও ওদের পরিবার হত্যাকাণ্ডসহ নানাবিধ কুকর্ম ঘটিয়ে দিব্যি স্বাধীনভাবে মুনিয়ার মুক্তিযোদ্ধা বাবার স্বাধীন করা বাংলাদেশে দর্প ভরে বেঁচে ছিল, এখনো বেঁচে আছে। ভবিষ্যতেও হয়তো বেঁচে থাকবে। মিডিয়া আগে থেকেই ওদের কাছে বিক্রি হয়ে আছে। মিডিয়া, প্রশাসন ওর হাতের ক্রীড়ণক! আহ! মুনিয়া! এমন ভুল কেন করলে! কেন এই নারীখেকো মাংসলোভী হারামজাদাটাকে বিশ্বাস করলে? কেন ওর মুখোশ খুলে দিলে না? নিশ্চয়ই ওরা তোমাকে বেশ্যার তকমা দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে পার পেয়ে যাবে।মুনিয়া হতাশ বোধ করে। ওকে কিছু করতে হবে। কিছু একটা। কিন্তু কী সেটা? আর ও কীভাবে করবে?ন্যায়ের পক্ষে এই লড়াইয়ে এদেশে একজন মানুষ এখনও আছেন– যিনি মুদ্রা বা মোহরের কাছে নিজেকে বিক্রি করেননি। মুনিয়াকে যে করেই হোক, তাঁর নিকট যেতে হবে। সেই মাননীয় মানুষের কাছে যেতে হবে ওকে। মুনিয়া হাওয়া কেটে গণভবনে পৌঁছে যায়।রাত আনুমানিক তিনটা বাজে। মহান মাননীয়া তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠেছেন। তিনি এখন পবিত্র মহাগ্রন্থের বাণী পাঠ করবেন। মুনিয়া মৃদু পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি কিছুটা বিরক্ত হন। এবার মুনিয়া অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, কেউ তার অস্তিত্ব টের না পেলেও তিনি ওকে দেখতে পাচ্ছেন ওর কথা শুনতে পাচ্ছেন।মুনিয়া সাহস সঞ্চয় করে সবিস্তারে ওর ঘটনা বর্ণনা করলো। তিনি চুপ করে মনেযোগ সহকারে সবকিছু শুনলেন। কথা শেষ করে মুনিয়া প্রশ্ন রাখলো, শেষবিচারের দিনে মহান মহামহিম আল্লাহ তাঁর হক আদায় না করলেও হয়তো ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু ন্যায়বিচার প্রত্যাশী মানুষের হক আদায় না করার অপরাধে জ্বলন্ত অনন্ত অগ্নিকুন্ড থেকে কে আপনাকে রক্ষা করবে? স্বয়ং বিধাতাও যে এখানে অপারগ।মুনিয়ার এমন তীব্র মন্তব্য শ্রবণ করে মহান মাননীয়া চমকে উঠলেন! আজ রাতে তাঁর পবিত্র মহাগ্রন্থের বাণী পাঠ করা হলো না। তিনি তাহাজ্জুদ আদায় করতে পারলেন না। সাহরি খেতে ভুলে গেলেন। তিনি দ্রুততার সঙ্গে ল্যাপটপ টেনে অতি জরুরি কিছু কাজের নির্দেশ দিতে কাজের মধ্যে ডুবে গেলেন। মসজিদে ভোরের আযানে মুয়াজ্জিন ঘোষণা করলেন, ‘ঘুম থেকে নামায উত্তম।’কিন্তু আজ এই মহান আহবানও তাঁর কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো না। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। কাজ করতে করতে ভাবেন তিনি। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একমাত্র এটাই তাঁর ধর্ম! আজ প্রথমবার প্রজাতন্ত্রের মাননীয় প্রধান নির্বাহীর ফজরের নামাজ ক্বাযা হয়ে যায়।
লেখক ও পরিচিতি
সালমা খানম,
জাতীয় পর্যায়ের একজন নারী লেখক, গল্পকার,
কবি ও গ্রন্থ প্রণেতা, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১ মে, ২০২৩