নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্ত পরিস্থিতি থমথমে হয়ে আছে। শুক্রবার রাতে মর্টার শেলে নো-ম্যান্স ল্যান্ডে রোহিঙ্গা নিহত ও শিশুসহ আরও কয়েকজন আহত হবার পর হতে বাংলাদেশ অংশেও আতংক ভর করেছে। শনিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাতেও ঘন্টা খানেক পর পর ভারী গোলা বিস্ফোরণের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়েছে সীমান্তের উভয় পার। রবিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থেমে থেমে গোলাবর্ষন হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এ বর্ষণ।ফলে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সীমান্তের আশপাশে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি সীমান্তরক্ষী বিজিবি। সীমান্ত বা তুমব্রু বাজারের কাছাকাছিও যেতে পারছেন না গণমাধ্যমকর্মী, ব্যবসায়ী বা বাইরের কোন বাগান মালিকও। পরিচয় প্রদান সাপেক্ষে স্থানীয়রা অল্প পরিসরে যাতায়তের সুযোগ পাচ্ছেন। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ভয়ে তেমন কেউ বেরও হচ্ছে না। জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা টহল। এ কারণে রাস্তাঘাটে তেমন মানুষও নেই।তুমব্রু সীমান্ত এলাকার সিএনজি অটোরিকশা চালক রিদুয়ান আহমেদ বলেন, ওপারে গোলাগুলি ও শুক্রবার মর্টার শেল এসে যুবক নিহত হবার পর সড়কে মানুষ নেই বললেই চলে, তাই ভাড়াও নেই। তবুও পেটের দায়ে সড়কে বের হয়েছি। তবে কখন মিয়ানমারের ছুঁড়া মর্টার সেল এসে পড়ে সেই ভয়-আতঙ্ক নিয়ে গাড়ি চালায়।তুমব্রু এলাকার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্ত এলাকার অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী। মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে আতংকে সবপেশার মানুষ এখন কর্মহীন। যুদ্ধবিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ, দিনরাত গোলাগুলির শব্দেও গত প্রায় একমাস জীবনযাত্রা মোটামুটি স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু গত শুক্রবার মর্টার শেল এসে রোহিঙ্গা তরুণ নিহত হবার পর চরম আতঙ্ক ভর করেছে সবার মাঝে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে, কৃষক মাঠে যেতে, ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলতে ভয় পাচ্ছে সীমান্তে। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে সীমান্তবাসীর।নাইক্যংছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন বলেন, ১৯৭২ সালের পর হতে মিয়ানমারে আভ্যন্তরিণ সংঘাতের কারণে এ দেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গারা। তারা আগে দেখাতো বিদ্রোহী সংগঠন আরএসওর সাথে সংঘাত। কিছুদিন আগে দেখিয়েছে আরসা ও আল-ইয়াকিনের সাথে সংঘর্ষ। এখন দেখাচ্ছে আরাকান আর্মির সাথে সংঘাত। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এটি তাদের সাজানো নাটক। ২০১৭ সালের পর যেসব রোহিঙ্গা ওপারে রয়ে গেছে তাদের সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ কিংবা অন্যদেশে পাঠিয়ে দিতে তারা এখন গোলাবারুদে আতংক ছড়াচ্ছে। তমব্রু এলাকার বাসিন্দা হাফিজুল ইসলাম বলেন, ঘন্টাখানেক পর পর মিয়ানমারের সীমান্ত ঘেঁষে ভারী অস্ত্র বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। রাতের বেলা এ অস্ত্রে আগুন দেখা যায় আকাশে। ভারি অস্ত্রের বিকট শব্দে তুমব্রু সীমান্তের এপারের মাটির দেয়াল, কাঁচের জানালা, পুরাতন কিংবা সেমিপাকা বাড়ির দেয়ালে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে। থমথমে পরিস্থিতিতে অনেকটা ঘরবন্দী হয়ে আছে সীমান্তের মানুষ।এদিকে, স্থানীয় মানুষের জীবনের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভিন তিবরিজী।অন্যদিকে, সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতিতে নাইক্ষ্যংড়ি উপজেলা প্রশাসন আতঙ্কিত সাধারণ মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া মানুষদের খোঁজখবর নেয়া এবং সীমান্তবাসীদের আতঙ্ক কাটাতে কাজ করছেন উপজেলা কর্মকর্তারা। রবিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনদের সাথে বৈঠক হয়। ইউএনও সালমা ফেরদৌসের সভাপতিত্বে রুদ্ধধার এই বৈঠকে সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকের বিভিন্ন সুপারিশনামা লিখিত আকারে জেলা প্রশাসক বরাবরে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য তসলিম ইকবাল চৌধুরী। তিনি বলেন, সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। সাধারণ মানুষকে নিরাপদে রাখতে এবং চলমান এসএসসি পরীক্ষার্থীদের সুষ্ট ভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করার নিমিত্তে স্থানীয় সরকারদলীয় নেতৃবৃন্দ এবং জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা ফেরদৌস বলেন, সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক ভাবে জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হচ্ছে এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে আছে। সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদার, তুমব্রু সীমান্তবাসীদের অভয় ও নিরাপত্তা প্রদানে কাজ করছে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসন।