গাজীপুরের কালীগঞ্জে জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল গ্রুপের রক্ত পুশ করায় প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতালের পরিচালক বন্যা বেগমের পক্ষে নানাভাবে সমঝোতার চেষ্টা করছে স্থানীয় একটি মহল। এরই মধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি ডাক্তার সানজিদা পারভীনকে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। তবে ইতিমধ্যে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ বেশ কিছু তথ্য। ঐ নারীর সিজার করেন মাসুদুর রহমান মাসুদ নামের একজন অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক। রোগীর শরীরে এবি পজিটিভ রক্তের বদলে বি পজিটিভ রক্ত পুশ করেন নার্স শামীমা। আর শিরিন বেগমের আলট্রাসনোগ্রাম করেন মেডিক্যাল সহকারী আশিকুর রহমান।নিহত শিরিন বেগমের স্বামী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, রবিবার সকাল থেকে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে জনসেবা হাসপাতাল যাই। সেখানে কোনো ডাক্তার না থাকলেও হাসপাতালের এক নার্স রোগীর কাগজপত্র দেখে বলেন সিজার হবে আপনি রোগী নিয়ে আসেন। এরপর মাসুদ নামের এক ডাক্তারকে মোবাইলে ডেকে আনেন। তিনি সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা সময় ধরে সিজার করেন। এ সময় রোগীর এবি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজনে রক্ত সংগ্রহ করতে বলা হয়। ডাক্তারের কথা মতো দুই জন রক্তদাতা সংগ্রহ করা হয়। শুরুতে একজনের কাছ থেকে এক ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে পুশ করা হয়। আরো এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজনে ভাগনের কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করতে তাকে হাসপাতালের বেডে শোয়ানো হয়। এরই মধ্যে ঐ হাসপাতালের নার্স শামীমা বি পজেটিভের রক্ত পুশ করেন। রক্ত চলা অবস্থায় রোগীর শুরু হয় খিচুনি। এ সময় ছুটে গিয়ে দেখি রোগীর শরীরে বি পজিটিভ রক্ত চলছে। এবি পজিটিভ আরেক জন রক্তদাতা রক্ত দিতে বেডে শুয়ে ছিল। বি পজেটিভ রক্ত চলার কারণ জানতে চাইলে হাসপাতালের ল্যাব সহকারী শাওন মিয়া ছুটে এসে বলেন কোনো সমস্যা নেই। পরে আস্তে আস্তে রোগীর অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। রোগীর অবস্থা খারাপ দেখে হাসপাতাল কতৃর্পক্ষ তড়িগড়ি করে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার উত্তরার সিএম হাসপাতালে পাঠায়। রাতে ওই হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক অ্যাম্বুলেন্সের কাছে এসে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, রোগীকে মৃত অবস্থায় এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তার পরও আরো নিশ্চিত হতে ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সেখানেও জানানো হয় রোগীকে মৃত অবস্থায় এখানে আনা হয়েছে।অনুসন্ধানে জানা যায়, মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সে চলছিল জনসেবা হাসপাতাল। ডাক্তার মাসুদুর রহমান মাসুদ একজন অ্যানেস্হেসিয়া চিকিৎসক। কিন্তু তিনি নিজেই করেছেন রোগীর সিজার। শুধু জনসেবা হাসপাতাল নয় স্থানীয় অনেক প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকে তিনি ফোন কলে এ কাজ করে থাকেন। তবে জানা গেছে অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক মাসুদের স্ত্রী শামীমা জাহান নূপুর একজন গাইনি ডাক্তার। কাগজপত্রে সিজারিয়ান চিকিৎসক হিসেবে ব্যবহার করা হয় মাসুদের স্ত্রীর নাম। আর অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন মাসুদুর রহমানের নাম। তবে হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো দিনও এই হাসপাতালে সিজার করতে আসেননি গাইনি ডাক্তার শামীমা জাহান নূপুর। অন্যদিকে আলট্রাসনো করার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ঘটনার দিন তা করেছেন মেডিক্যাল সহকারী আশিকুর রহমান। তিনি নিয়মিতই এ হাসপতালে আলট্রাসনোগ্রাম করেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর দেড়টায় হাসপাতালে গেলেও সেখানে মালিক ও চিকিৎসক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। বক্তব্য নিতে তাদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিয়ে তা বন্ধ পাওয়া গেছে।স্থানীয়রা জানায়, কিছুদিন আগে হাইকোর্টের নির্দেশে দেশের সকল স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালিত হয়। তার পরও কেন জনসেবা হাসপাতাল মেয়াদোত্তীর্ণ কাগজে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে? সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বিষয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার (ইউএইচএফও) দেখার কথা ছিল। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মনজুর-ই-এলাহী (ইউএইচএফও) বলেন, এ ব্যাপারে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি বিভাগের চিকিৎসক সানজিদা পারভীনকে আহ্বায়ক ও ডা. মুনমুন আক্তার, অ্যানেস্থেসিয়া মো. এমরানকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ঐ তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আসসাদিকজামান বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পেলে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আনিসুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ কেউ নিয়ে আসেনি। অভিযোগ না করলে তো আমরা কারো বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি না। তবে অভিযোগ পেলে তদন্তসাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।উল্লেখ্য, গত কালীগঞ্জে জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল ভুল গ্রুপের রক্ত পুশ করায় শিরিন বেগম (৩০) নামের এক প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। প্রসূতির এবি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন থাকলেও তাকে পুশ করা হয় বি পজেটিভ রক্ত।