কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি—এ কথা সবার জানা। বাংলাদেশের মানুষ তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে আসছে। মানুষের মর্যাদায় ঘাটতি না থাকলেও অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি মুখে মুখেই থেকে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নজরুল ইসলামকে দেশে এনে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ তার সেই নির্দেশ মেনে ভালোবেসেই কবিকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগেই ১৯৭২ সালের ২৪ মে কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। কবির সঙ্গে তার দুই ছেলে সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরও নিয়ে আসা হয়। তারা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করলে আপামর জনতা তাকে সেখানে বিপুল সংবর্ধনা দেয়। সেদিনই রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে কবিকে দেখতে যান। ধানমন্ডিতে কবির বসবাসের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি বাড়ি দেওয়া হয়। বাড়িটির নাম দেওয়া হয় ‘কবি ভবন’। সেখানে কবিকে রাখা হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। কবি ভবনে প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উড্ডীন থাকত। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে সরকারি আদেশ জারি করা হয়। একই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি কবিকে ‘একুশে পদক’ দেওয়া হয়। কিন্তু জাতীয় কবি ঘোষণাসংক্রান্ত কোনো দলিল পাওয়া যায়নি।এদিকে ৫০ বছর পর কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ উল্লেখ করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের করা হয়েছে। গত ২২ জুন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আসাদ উদ্দিনসহ ১০ আইনজীবী এ রিট করেন। এতে সংস্কৃতিসচিব, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালককে বিবাদী করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সরকারি আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সবই পরোক্ষ স্বীকৃতি। এমন স্বীকৃতি কালের পরিবর্তনে মুছে যেতে পারে। এ কারণে তার নাম উল্লেখ করে গেজেট প্রকাশ করা দরকার। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চে এ রিটের ওপর শুনানি হতে পারে।সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণার গেজেট নোটিফিকেশন, প্রজ্ঞাপন বা অনুরূপ কোনো সরকারি আদেশ নেই। নজরুল বিশেষজ্ঞ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম রচিত ‘নজরুল-জীবনী’ গ্রন্থটিতেও এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সরকারি অনেক দলিলে তাকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আয়োজনে তাকে জাতীয় কবি হিসেবে লেখা ও বলা হয়। তার নামের সঙ্গে জাতীয় কবি ব্যবহার করে সংসদে একটি আইনও পাশ হয়েছে। আইনটি হলো, ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৬।’অন্যদিকে ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৮’-এর ২ ধারায় তাকে জাতীয় কবি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ধারা ২-এর ৩ উপধারায় বলা হয়েছে—‘কবি’ অর্থ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। একই ভাবে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে, অন্যান্য বইপুস্তকে, গবেষণাকর্মে, পত্রপত্রিকায়, সভাসমাবেশে সবখানেই কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি বলেই উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এসবই পরোক্ষ স্বীকৃতি।এ প্রসঙ্গে কবি নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী ইত্তেফাককে বলেন, ‘এ বিষয়ে কবি পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে। এটা ঠিক, দেশের মানুষ জাতীয় কবি হিসেবে তাকে সম্মান জানিয়ে আসছে। কিন্তু এটা সরকারি আদেশ হিসেবে আসাটা জরুরি। কারণ আমরা থাকব না, কিন্তু বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে। আগামী প্রজন্ম একদিন হয়তো না-ও জানতে পারে যে, আমাদের জাতীয় কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। মৌখিকভাবে তিনি জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত হলেও লিখিতভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের জন্যই কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট প্রকাশ করাটা উচিত হবে।’অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ এ বিষয়ে ইত্তেফাককে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের কবিতা, গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। নজরুল অনেক আগে থেকেই আমাদের হৃদয় জুড়ে ছিলেন, এরপর তাকে জাতীয় কবি হিসেবে আমরা হৃদয়ে স্থান দিয়েছি। এটা নিয়ে বিতর্কের কোনো স্থান নেই। তাই এটা সরকারিভাবে যাতে হয়, সেটাও দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’এ প্রসঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর ইত্তেফাককে বলেন, ‘কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইনে কবি নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরে আর কোনো গেজেট করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। আমি জেনেছি যে, হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। তার কপি পাইনি। এখন হাইকোর্ট যদি গেজেট করতে বলে, তাহলে অবশ্যই করব।