বর্ণিল উত্সবে খুলে গেল পদ্মা সেতুর দুয়ার। মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মার তীরে উন্মোচিত হলো ফলক, বাতাসে উড়ল রঙিন আবির, স্বপ্নের বিজয়োত্সবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে তিনি পদ্মা সেতুর ফলক উন্মোচন করে স্বপ্নের দুয়ার খুলে দেন এবং বক্তব্য প্রদান করেন। আর এর মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলো। প্রধানমন্ত্রী পরে সেতুর জাজিরা প্রান্তে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ীতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম পদ্মা সেতুর নির্মাণ বিষয়ক সূচনা বক্তৃতা করেন। তিনি প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম, উপ-পরিচালক কামরুজ্জামান, প্রজেক্ট ম্যানেজার অ্যান্ড সুপারভিশন কনসালট্যান্ট রবার্ট জন এভিসসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ কয়েক জনকে অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শিল্পকলা একাডেমি নির্মিত দেশের বরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে থিম সং- ‘বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন দেশ, তুমি দিলে পদ্মা সেতু, পৃথিবী তাকিয়ে রয়, মাথা নোয়াবার নয়’ পরিবেশিত হয়। পদ্মা সেতুর ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতু উদ্বোধন উপলক্ষ্যে স্মারক ডাক টিকিট, সুভ্যেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর এবং ১০০ টাকা মূল্যের স্মারক নোট অবমুক্ত করেন-এসময় পদ্মা সেতুর নির্মাণকারী কোম্পানির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে পদ্মা সেতুর একটি রেপ্লিকা উপহার দেওয়া হয়। নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে ফটোসেশনেও অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপরই প্রধানমন্ত্রী প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টোল দিয়ে সেতুর মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করেন এবং মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং বাংলাদেশের অটিজম আন্দোলনের পথিকৃৎ সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এসময় সঙ্গে ছিলেন।পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, ১৪ দলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, কূটনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি নেতৃবৃন্দ, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ আরো কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তারা অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত ছিলেন। এর আগে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় সমাবেশস্থলে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে সেতুতে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতুর মাঝামাঝি অংশে গাড়ি থামিয়ে নেমে সেতু ঘুরে দেখেন ও ফ্লাইং ডিসপ্লে উপভোগ করেন। এসময় সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে লাল-সবুজের মাস্ক পরিহিত প্রধানমন্ত্রীকে বেশ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। এরপর দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে জাজিরা প্রান্তে সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২-এর উন্মোচন করে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরষদ সচিব মোশাররফ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।দুপুর ১২টা ৫১ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী কাঁঠালবাড়ীতে জনসভাস্থলে এসে পৌঁছান। এ সময় লাখো নেতাকর্মী করতালি ও স্লোগান দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঞ্চে আসার পর বক্তৃতা করেন চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এর আগে বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, শেখ হেলাল এমপি, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক খোকা শিকদার প্রমুখ। সভা যৌথভাবে পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ও প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। জনসভা শেষে পদ্মা সেতুর শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের সার্ভিস এরিয়া-২-এর উদ্দেশ্যে সড়ক পথে যাত্রা করেন প্রধানমন্ত্রী। বিকাল ৫টায় হেলিকপ্টারযোগে জাজিরা থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।বেলা সাড়ে ১১টায় কাঁঠালবাড়ীর জনসভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ফজরের নামাজের পর থেকেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে জনসভাস্থলে আসতে থাকেন নেতা-কর্মীরা। সড়ক ও নৌপথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলা থেকে আওয়ামী লীগের কয়েক লাখ নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনসভায় যোগদান করেন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় গতকাল ছিল যেন ঈদের আনন্দ। জনসভায় পদ্মা সেতুর আদলে সাজানো মঞ্চের পিলার ছিল ১১টি। দ্বীপ জেলা ভোলা থেকে এসেছেন প্রবীণ জব্বার হোসেন (৭৮)। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। আর তার কন্যা শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণ করে আমাদের আজন্ম দুর্দশা থেকে মুক্তি দিলেন।’ বরগুনা থেকে এসেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, ‘একটি সেতুর জন্য আমাদের ঢাকায় যেতে এক দিন লেগে যেত। এখন আমরা সহজেই পার হতো পারব।’ জনসভায় আসা জালালপুর আইডিয়াল স্কুলের সহকারী শিক্ষক আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমাগো আর ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। পোহাতে হবে না যানজট, ভোগান্তি। এখন অল্প সময়ের মধ্যে যেতে পারব ঢাকা। করতে পারব সুচিকিৎসা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের রঙিন উত্সবে আবেগ ছুঁয়ে গেল সবাইকে, সেতুর ফলক উন্মোচন করে মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে সেলফিবন্দি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। সকালে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় সেতুর সার্ভিস এরিয়ায় সুধী সমাবেশ শেষ করে পদ্মা সেতু এলাকায় প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তার সঙ্গে হাঁটছিলেন মেয়ে সায়মা ওয়াজেদও। একপর্যায়ে নিজের মোবাইল ফোন বের করে মায়ের সঙ্গে সেলফি তোলেন তিনি-পদ্মা সেতু পার হতে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে গুনতে হয়েছে ৭৫০ টাকা। এ সময় নিজের গাড়িবহরের সব কটির টোল পরিশোধ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী মোট ১৬ হাজার ৪০০ টাকা দেন। সেই সঙ্গে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে খুলল আয়ের খাতা। উদ্বোধন শেষে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের উদ্দেশে যাত্রা করেন শেখ হাসিনা।মাঝ সেতুতে দাঁড়িয়ে বিমান বাহিনীর ৩১টি বিমান ও পাঁচটি হেলিকপ্টারের সমন্বয়ে এক মনোজ্ঞ ‘ফ্লাইং ডিসপ্লে’ উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। একটি হেলিকপ্টার বহন করে লাল-সবুজ পতাকা, যা জানান দেয় বাঙালির আত্মমর্যাদা, সক্ষমতার। দ্বিতীয়টিতে ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সংবলিত পতাকা। তৃতীয় হেলিকপ্টারে ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি সংবলিত পতাকা। চতুর্থ ও পঞ্চম হেলিকপ্টার বহন করে স্বপ্নজয় ও জাতীয় স্লোগান জয়বাংলা সংবলিত পতাকা। পদ্মার আকাশে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে ও ফ্লাই পাস মন্ত্রমুগ্ধ করে অপেক্ষমাণ পদ্মাপারের মানুষকে।পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর অল্প সময়ের জন্য তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। দুই পারে এক কিলোমিটার পর্যন্ত সর্বস্তরের জনগণকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলেও তা মানেনি কেউ। একসময় উৎসুক জনগণ ব্যারিকেড ভেঙে সেতুর আরো ভেতরে প্রবেশ করে। মাওয়া প্রান্তেও দুপুর ২টার পরে পদ্মা সেতুর কাছে যেতে ভিড় করে জনসাধারণ। অনেকে নিরাপত্তা বেষ্টনী (তারের জাল) ছিঁড়ে সেতুর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেন।