চিকিৎসকদের মধ্যে দলবাজিতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি—সবক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়ছে। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের মেধাবী চিকিৎসকরা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে রোনাল্ড রিগ্যান গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। তখন তার সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকের কাছে রিগ্যান জানতে চেয়েছিলেন, আপনি ডেমোক্র্যাটিক নাকি রিপাবলিকান? অর্থাত্ বিশ্বের সব দেশেই দলবাজির এই প্রবণতা আছে। তবে উন্নত দেশগুলোতে দলবাজি হলেও মেধার ক্ষেত্রে তারা কখনো আপস করে না। চিকিৎসকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলির ক্ষেত্রে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। এখানে সবক্ষেত্রে দলবাজিই প্রাধান্য পায়। শুধু বর্তমান সরকারের আমলে নয়, অতীতের সব সরকারের আমলেই চিকিৎসকদের মধ্যে দলবাজি চলে আসছে। দলবাজিতে জড়িত বেশির ভাগ চিকিৎসক সময়মতো হাসপাতালে আসেন না, আবার এলেও তারা অল্প সময় থেকে চলে যান। রাজধানী থেকে তাদের বেশির ভাগকে বাইরে বদলিও করা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতেই তারা অবস্থান করছেন।বিএনপির আমলে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্রাব) এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বাধীনতা চিকিৎসক (স্বাচিপ) স্বাস্হ্য খাত নিয়ন্ত্রণ করে। বছরের পর বছর ধরে একশ্রেণির চিকিৎসক রাজনীতি, সংগঠন, দলাদলি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। রাতারাতি সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত মহলটি চিকিৎসাসেবা দেওয়া তো দূরের কথা, বরং নানা কূট-কৌশলে স্বাস্হ্য সেক্টরকেই ভঙ্গুর করে দিচ্ছে। এতে বিপুলসংখ্যক মেধাবী চিকিৎসকের কাছে দিন দিন পেশাদারিত্বটা গৌণ হয়ে উঠেছে। বিএনপির আমলে ড্রাবের নেতাকর্মীরা সুযোগসুবিধা পেয়েছেন, এখন পাচ্ছে স্বাচিপের নেতাকর্মীরা। অর্থাত্ দলবাজরা সব সময়ই সুযোগসুবিধা পাচ্ছে। ১০ জন সিনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, চিকিৎসাবিজ্ঞান হলো মহাসাগরের মতো। এ শিক্ষার কোনো শেষ নেই। তাই চিকিৎসকদের শুধু ডিগ্রি নিয়ে থাকলে হবে না। ওষুধ ও রোগ সময়ে সময়ে পরিবর্তন হচ্ছে। এসব বিষয়ে আপডেট থেকেই চিকিৎসাসেবা দিতে হয়। কিন্তু সঠিকভাবে চিকিৎসাশিক্ষা দিতে হলে দলবাজি করব কখন?দেশের হাসপাতালগুলোও দলবাজদের কাছে জিম্মি। রোগীদের চিকিৎসায় মেডিক্যাল বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রেও দলবাজি চলে। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মেডিক্যাল বোর্ড গঠনে প্রখ্যাত এক চিকিৎসককে রাখা হয়নি। কারণ তিনি কোনো দল করেন না। অথচ ঐ চিকিৎসকের যে অভিজ্ঞতা, বোর্ডে থাকা অন্যদের তার ধারের কাছেও নেই। ‘ঐ অধ্যাপককে কেন বোর্ডে রাখা হয়নি?’—বোর্ডের এক সদস্য অন্য সদস্যদের কাছে তা জানতে চাইলে উত্তরে তারা বলেন, তিনি আমাদের লোক নয়।এদিকে দলবাজিতে জড়িত অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। রাজধানীর একটি হাসপাতালের পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ সম্পর্কে স্বাস্হ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও অবহিত। শোনা যায়, সন্ধ্যায় হাসপাতালের অফিসেই মদের আসরে বসেন ঐ পরিচালক। দুদকে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে মামলা হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কিছুই করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এই হাসপাতাল পরিচালকের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয়নি। উলটো তিনি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। রাজধানীর আটটি সরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ বলেন, চিকিৎসকদের দলবাজি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ দলবাজির কারণে চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তা বলেন, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে চিকিৎসকদের পদোন্নতি ও বদলি হওয়া উচিত। কিন্তু দলবাজির কারণে তা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। দলবাজির কারণে রোগীরা সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অপরদিকে মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীরা সুশিক্ষা থেকে হচ্ছেন বঞ্চিত। একই সঙ্গে উপযুক্ত পদায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।চিকিৎসকদের মধ্যে দলবাজির কারণে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা হতাশ। তারা এক বাক্যে বলেন, চিকিৎসা পেশা নিয়ে দলবাজি করা উচিত নয়। দলবাজির কারণে স্থানীয় স্বাস্হ্য প্রশাসনে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা সমস্যা দিন দিনই বাড়ছে। তাদের মতে, বিএমএ বা স্বাচিপ-এর মতো সংগঠনগুলোর কাজ হবে শুধু চিকিৎসা পেশার মান উন্নয়ন এবং যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য স্থানে পদায়নে প্রশাসনকে পরামর্শ প্রদান।বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, চিকিৎসাসেবা নিয়ে দলবাজিকে বিএমএ’র পক্ষ থেকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। চিকিৎসকদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। আর এটা বাস্তবায়ন করা প্রশাসনের দায়িত্ব।স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, চিকিৎসকরা যে দলই করুক তাদের পরিচয় চিকিৎসক। আর চিকিৎসক হিসেবেই যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তাদের মূল্যায়ন করতে হবে।