বিষণ্ন বিকেলটাকে আরো তৃষ্ণায় ভরিয়ে তুলেছে যেন হেমন্তের হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন শরীর। সূর্য হেলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে আবিরের রঙ ছড়িয়ে। একটা ভারী মেঘের আবরণ বুকে চেপে একমনে নদীর জলে দিনের শেষ আভাটুকু ডুবে যেতে দেখে নির্ঝর। বুকের ভিতর বয়ে চলা তুমুল ঝড়ে লণ্ডভণ্ড তার সময়ের গতিপথ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নির্ঝর। একান্নবর্তী পরিবারে বাবা চাচা দাদা দাদী ভাই বোন সবার একটা সুখের রাজ্য যেনো। এই আধুনিক যুগের এমন সময়ে একান্নবর্তী পরিবারে বাস করা তো কল্পনার মতো। কিন্তু পারিবারিক আদর্শ ও ঐতিহ্য তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ আনতে পারেনি। ফারিহা নির্ঝরের চার বছরের ছোট। ওরা চাচাতো ভাইবোন। ফারিহা কলেজ শেষ করলো সদ্য। আর দাদা দাদী নাতনীর বিয়ে দেখে মরতে চান। বয়স হয়েছে অবশ্য তাদের। কিন্তু ফারিহা কল্পনাও করেনি সব স্বপ্ন, আশা, ভরসা জলাঞ্জলি দিয়ে এখনই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে।বহুবার,বহুভাবে ইশারায় নির্ঝরকে সে বোঝাতে চেয়েছে যে সে তাকে ভালোবাসে। বরাবরই নির্ঝর ওর বিষয়টা দুষ্টুমি ভেবে উড়িয়ে দিয়েছে। ভেবেছে ভাই বোন আবার প্রেম কিসের।
নির্ঝরকে বোঝার বয়স হবার পর ভুলেও ফারিহা ভাইয়া ডাকেনি। নাম ধরে ডাকতো। নির্ঝর বকা দিলে বলতো, তোকে তো আমি বিয়ে করবো, তারপর সোয়ামী বলে ডাকবো, এখন যা ডাকি তাতেই সন্তুষ্ট থাক। নির্ঝর তাকে মারতে গেলে খিলখিলিয়ে হেসে পালাতো।কখনো তার আচরণটা নির্ঝরের কাছে দৃঢ় মনে হয়নি। ভীষণ দুষ্টুমি আর বাৎসল্যে ভরা ছিলো ওর সবকিছু। পড়াশোনা কিংবা পারিবারিক অবস্থানের কারণেও এভাবে আসলে ভাবা হয়নি ফারিহাকে নিয়ে।বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পরীক্ষা চলছিলো। হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন এলো পরীক্ষা শেষ হতেই যেনো বাড়ি চলে যাই। ফারিহার বিয়ে মোটামুটি পাকা। দিন তারিখ ঠিক হলেই বরপক্ষ এসে বিয়ে পরিয়ে একবারে নিয়ে যাবে ফারিহাকে। ছেলে চট্টগ্রামে সরকারী চাকরী করে। বিয়ের পর ফারিহাকে ওখানেই থাকতে হবে। কথাগুলো শুনে বুকের ভিতর একটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সত্যি চলে যাবে পাগলীটা? বাড়িটা তো একদম শূন্য হয়ে যাবে তাহলে!
দু’টো পরীক্ষা বাকী ছিল, শেষ করেই কোনভাবে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে সে।সন্ধ্যার একটু আগে পৌঁছে যায় নির্ঝর। ব্যাগ রেখেই বোনের খোঁজে হন্তদন্ত ছুটে, অবশেষে খুব অনাড়ম্বরভাবে তাকে খুঁজে পায় বারান্দার এক কোণে উদাস চোখে অসীম শূন্যতা নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়া কোনো অপরিচিতারূপে।
সে আসাতে বিন্দুমাত্র উচ্ছ্বাস পাওয়া যায়নি তার চাহনীতে।কী রে পাগলী এই ঘোর সন্ধ্যায়,একা একা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? এত কি তাড়া ছিলো বিয়ের। আমাকে না জানিয়েই রাজি হয়ে গেলি!না, ভাইয়া, আমার ইচ্ছায় কিছুই হচ্ছে না। পরিবারের সবার সিদ্ধান্তে আমি শুধু মত দিয়েছি। তাছাড়া, আমার তো কেউ নেই যার জন্য অপেক্ষা করবো। তাই আর দ্বিমত করিনি। বলতে বলতে অন্ধকার ছাপিয়ে ওর দু’চোখের জল ছলছল করে ঝরে পড়ছিলো।যে ভাইয়া ডাক শোনার জন্য কত বকেছি, মেরেছি! আজ ঐ ডাক শুনে বুকের ভিতরটা কেমন হাহাকার করে উঠলো। মনে হলো পৃথিবীর সব চাইতে আপন মানুষটি আমাকে পর করে দিলো। আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শুধু এটুকু বুঝতে পারলাম আমিও ওকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছি। তারপর ওর হাত দু’টো অকস্মাৎ চেপে ধরে বললাম, বিয়েটা ভেঙে দেই চল। আমি তোকে ভালোবাসি পাগলী, তোকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। প্লিজ আমাকে একা করে দিসনা।অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ফারিহা নির্ঝরের মুখের দিকে, চোখে তাকানোর সাহস তার নেই। নিজেকে এই মুহূর্তে দুর্বল করতে চায় না সে। শুধু বলে, ভাইয়া অনেক দেরী হয়ে গেছে, এখন আর কিছু করার নেই। বলেই দ্রুত বাসার ভিতরে চলে যায় সে। নির্ঝর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে দূরে, বহুদূরে যেখানে শুধু শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।ফারিহার বিয়ে হয়ে যায়, শ্বশুরবাড়ি চলে যায় সে। নির্ঝর বুঝতে পারে কি ভুল সে করেছে হাসি খেলার ছলে। জীবনটাই যেনো কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো মুহূর্তে। বেঁচে থাকাটা অভিসম্পাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।নির্ঝরের দু’চোখ জুড়ে এখন কেবলই শূন্যতা। ঐ দূরের আকাশ কিংবা নদীর কলতান বুকের ভিতর অবিরত শূন্যতার করুণ সুরে হাতছানি দিয়ে ডাকে থেকে থেকে।
লেখক-
ফাতেমা ইসরাত রেখা
কবি, আবৃত্তি-গল্পকার ও
গ্রন্থ প্রণেতা