ভালোবাসার বিয়ে। বিয়ের পরদিনই মেয়েকে স্বামীর কাছ থেকে নিয়ে যান মা ও মামারা। কিন্তু দশ মাস পর সেই মেয়েই উচ্চ আদালতে হাজির হয়ে বললেন তিনি তার স্বামীর কাছে যেতে চান। এতদিন তিনি যেখানে ছিলেন সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একবার নয় দুইবার আদালতের ডায়াসের সামনে এসে অকপটেই তিনি দিয়েছেন তার এই জবানবন্দি। সেই জবানবন্দি বিবেচনায় নিয়েই হেমা শর্মাকে তার স্বামীর হাতের তুলে দিয়েছেন হাইকোর্ট।আদালত বলেছেন, দু’জনের মধ্যে যে বিয়েটা হয়েছে সেটা সেটা তরুণী বা ছেলের পরিবারের কেউ অস্বীকার করছে না। আর আদালতে হাজির হয়ে এই তরুণীও বলেছে সে স্বামীর কাছে যেতে চান। তার স্বামীও তাকে নিয়ে যেতে উচ্ছুক। আর তরুণীও এটাও বলেছে যে মামার বাড়িতে থাকাকালে সে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এ কারণে এই তরুণীর স্বাভাবিক ও নিরাপদ জীবনের স্বার্থে তাকে তার স্বামীর হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার এই আদেশ দেন।এরপরই সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা হেমা শর্মাকে তার স্বামী শ্যাম সুন্দরের হাতে তুলে দেন। স্বামীর কাছে ফিরতে পেরে খুশি হেমা শর্মা। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার খুবই ভালো। কিন্তু বিঞ্চু রায় নামে একটা লোকের কারণে আমার আজ এই অবস্থা। আমি আমার স্বামীকে পেয়েছি। আমি আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট।’তার স্বামী শ্যাম সুন্দর বলেন, ‘বিয়ের পর আমার নামে অপহরণসহ নানা মামলা দেওয়া হয়েছে। আমি চাই আমার নামে করা মিথ্যা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক। আমি আমার স্ত্রীর মা ও মামাদের সম্মান করি। আশা করি তারা আমার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনের সুযোগ করে দিবেন।’ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত ১৩ জানুয়ারি ধর্মীয় নিয়ম মেনে শ্যাম সুন্দর ও হেমা শর্মা উভয়রে সম্মতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর আগে গত বছরের ২১ নভেম্বর রংপুরের নোটারি পাবলিকে এফিডেভিট সম্পন্ন করেন তারা। বিয়ের বিষয়টি জানার পর হেমাকে পরদিন ভোর রাতে জোর করে তুলে নিয়ে যায় তার পরিবার। পরে এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করেন শ্যাম। কিন্তু কমিশন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় হাইকোর্টে রিট করেন তিনি।ওই রিটে বলা হয়েছে, শ্যামের বয়স ২২ বছর, আর হেমার ১৯ বছর। হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৩ এর বিধি ২২(১)(ক) অনুযায়ী দুজনে বিয়ে নিবন্ধিত হয়। দু’জনের বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জে। কিন্তু বিয়ের পরদিনই তার স্ত্রীকে তার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে স্ত্রীর ফোন পেয়ে তার কাছ থেকে জানতে পারেন যে তার বয়স ১৫ বছর দেখিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে (আসক) রেখে গেছেন তার মামা গণেশ শর্মা। পরে সেখান থেকে ২৫ মে মামা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। এরপর থেকে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারছেন না। রিটে আরও বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী তারা এখন স্বামী স্ত্রী। কেউ তাদের এই পবিত্র সম্পর্ককে অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু এই বিয়ে মেয়ের মা ও মামারা মেনে নিতে পারছেন না। ইতোমধ্যে তার স্ত্রীকে বিদেশে পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। ভিসাও যোগাড় করে ফেলেছেন।রিটে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজি, রংপুর পুলিশ সুপার, বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সাত জনকে বিবাদী করা হয়েছে। ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৩১ অক্টোবর হাইকোর্ট হেমা শর্মাকে আদালতে হাজির করতে তার মা সাবিত্রী রায় ও মামা গণেশ শর্মা ও নারায়ণ শর্মাকে নির্দেশ দেয়। তারা যেন নির্বিঘ্নে আদালতে হাজির হতে পারেন সেই বিষয়ে রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনা মোতাবেক সকালে তাদেরকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপরই হেমা শর্মা ও তার মা ও মামাদের বক্তব্য গ্রহণ করে আদালত। পাশাপাশি শ্যাম সুন্দরের পিতার বক্তব্যও নেওয়া হয়। সেই বক্তব্যে শ্যাম সুন্দরের পিতা বলেন, আমরা এই বিয়ে মেনে নিয়েছি। নানাভাবে আপস করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মেয়ের পরিবার বলেছে যা হবে আদালতেই হবে। আদালতে শ্যাম সুন্দরের পক্ষে এম তাজুল ইসলাম ও মেয়ের মায়ের পক্ষে খুররম শাহ মুরাদ শুনানি করেন।