এলো খুশির ঈদ। আগামীকাল রবিবার দেশে ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ করোনা মহামারির পর নানামুখী অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে দেশের মানুষ।এ পরিস্থিতিতে তবুও মানুষ মেতে উঠেছে ঈদের আনন্দে। রাজধানীর কোরবানির হাটগুলোতে ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় ভিড় বেড়ে গেছে। সারা দেশেই কোরবানি কেনা নিয়ে মানুষের মাঝে উত্তেজনা। তবে, গত পাঁচ-ছয় বছরে হঠাৎ করেই গরু-ছাগলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষ কোরবানি দিতে পারছেন না। যারা কোরবানি দিচ্ছেন, তারা যেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোরবানির আনন্দ ভাগ করে নেন সে চেষ্টাও আমাদের থাকতে হবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় সেই মন্ত্রই যেন উচ্চারিত হয়েছে : ‘শুধু আপনারে বাঁচায় যে/ মুসলিম নহে ভণ্ড সে/ ইসলাম বলে বাঁচ সবাই/দাও কুরবানি জান ও মাল/ বেহেশত তোমার কর হালাল/ স্বার্থপরের বেহেশত নাই।’ (শহীদী ঈদ) করোনা মহামারি পেরিয়ে এ বছর ঈদুল আজহা অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশেই পালন করবে দেশবাসী। মহামারির প্রকোপ কমে আসায় ঈদের আনন্দ ফিরে এসেছে মানুষের জীবনে। এ বছর ঈদুল ফিতরও নির্বিঘ্নেই কেটেছে। করোনার প্রকোপ আবারও বাড়তে শুরু করেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রমণের ভয় তেমন নেই। ঈদুল আজহার আগে তাই আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ।ঈদের দিনে জামায়াতে নামাজ পড়া শেষে কোরবানি দেওয়া, বাসায় রান্না আর আত্মীয় বাড়িতে মাংস দেওয়া, সবই চলবে নিয়মমাফিক। তবে, এবারের ঈদে আমাদের সামনে আসা কিছু কঠিন বাধা পাড়ি দেওয়ার জন্য মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হাত তুলে দোয়া চাইব আমরা। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বন্যাকবলিত অঞ্চলের মানুষের জীবনেও যেন ঈদের আনন্দ আসে, সে চেষ্টা আমাদের করতে হবে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে দেশ যে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে তা থেকেও যেন আমরা বেরিয়ে আসতে পারি, সারা দেশের মানুষ সম্মিলিতভাবে যেন তা মোকাবিলা করতে পারি, সেই দোয়াও চাইব। এবারের ঈদুল আজহায় মানুষকে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সবাই মিলে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে—এটাই হোক এবারের ঈদের সবার চাওয়া।বিভিন্ন স্থানে সড়ক সংস্কার, লেন বৃদ্ধি, ফ্লাইওভার চালু ও পদ্মা সেতু উদ্বোধনে এবারের ঈদযাত্রায় স্বস্তি মিলছে কিছু গন্তব্যে। তবে মহাসড়কে মালবাহী গাড়ির দুর্ঘটনা, যাত্রী ওঠানামা, খানাখন্দ, বৃষ্টি ও বেশ কয়েকটি ফিটনেসবিহীন গাড়ি বিকলের ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার থেকেই ভয়াবহ যানজটের মুখে পড়েন উত্তরবঙ্গের যাত্রীরা। ঢাকা থেকে গাজীপুর দেড় ঘণ্টার রাস্তা পার হতেই দুই থেকে তিন গুণ সময় লেগে যায়। এবার ঈদে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের বাড়ি ফেরার ঝক্কি কমে এসেছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনে ঈদ আনন্দের সঙ্গে যোগ হয়েছে পদ্মা সেতু পাড়ি দেওয়ার আনন্দ। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জন্য এবার যেন ডাবল ঈদ। এবার ঈদে মহাসড়কগুলোতে অন্যান্য বছরের তুলনায় যানজট কম। মানুষ সহজে তাদের গন্তব্যে পৌঁছেছে। পদ্মা সেতুতে চলাচল শুরু হওয়ায় মানুষ নির্বিঘ্নে যেমন বাড়ি পৌঁছাতে পারছে, তেমনি সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, পাটুরিয়া দৌলতদিয়া ঘাটেও যানবাহনের জট নেই। তবে, তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, সাভার আশুলিয়া সড়ক, ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে প্রতি বছরের মতোই সীমাহীন জ্যামের কবলে পড়েছেন ঘরে ফেরা মানুষ।ঈদ তো শুধু আনন্দ উপলক্ষ নয়, বাঙালি মুসলমানের কাছে এটা একধরনের মিলনমেলাও। জন্মের জায়গা, জন্মস্হান প্রতিটির সঙ্গে মানুষের নাড়ির যোগ রয়েছে। আত্মার স্পর্শ আছে। এটা একজন মানুষ আজীবন বহন করে বেড়ায়। বাড়ি মানেই তো শৈশব, কৈশোর, গাছপালা, সবুজ মাঠ, মা-বাবা, ভাই-বোন, নদী, পুকুর—এসব জড়িয়েই তো বাড়ি। বাড়ি ফেরা মানে, মানুষের তার আপন লোকদের মধ্যে ফিরে যাওয়া। যাদের সঙ্গে ভদ্রতা, কৃত্রিম আনুষ্ঠানিকতার পরিচয় নয়—তাদের সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক। সেই সান্নিধ্যের মধ্যে, মানুষের উষ্ণতার মধ্যে ফিরে যাওয়া। ‘ভাইয়ের মায়ের এমন স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ’—সে তো এই বাড়িতেই! মানুষ ফিরছে তার ফেলে আসা স্মৃতিগন্ধমাখা বাড়িতে, প্রিয় মানুষগুলোর কাছে।কমলাপুর রেল স্টেশনে কথা হয় জাহিদা আখতারের সঙ্গে। তার ছেলে ও মেয়ে দুজনেই ঢাকায় পড়ে। সে কারণেই তিনি ঢাকায় থাকেন। ঈদ এলেই ফিরে যান নওগাঁয়। বললেন, ‘প্রতি বছর ঈদের সময় বাড়ি যাই। প্রয়োজনে ঢাকায় থাকতে হয়। কিন্তু মন তো পড়ে থাকে সেই বাড়িতেই।কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন চাকরিজীবী ইকবাল আনোয়ার। যাবেন রংপুর। তিনি বললেন, ‘ভিড় ঠেলে টিকিট কেনা, জ্যাম ঠেলে বাড়ি যাওয়া কষ্টের। কিন্তু না গেলেও ভালো লাগে না। মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে যদি দেখাই না হলো, তাহলে ঈদের আর মজা কোথায়!